Tuesday, June 5, 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে





চিঠি— ৬


গভীর নির্জনতায় যার বাস, তার কাছেই ধরা দেয় গভীর কোনো বিষয়ের সুত্র
                                                                           রোম
                                                                 ডিসেম্বর ২৩, ১৯০৩                                                   

প্রিয় কাপুস,
চারদিকে ছুটির আমেজ, বড়দিনের উৎসবমুখর প্রস্তুতি, এমন সময় তোমার একাকীত্ব অন্যসময়ের চেয়ে আরো প্রবল হয়ে উঠুক তা হতে দেয়া যায় না। তাই তোমাকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে এই চিঠি। যদি দেখ তোমার নিঃসঙ্গতা গভীরে শেকড় ছড়াচ্ছে, তাকে মেনে নিও খুশি মনে। নিজেকে প্রশ্ন করো, যে একাকীত্বের শেকড় নেই তাকে কি নিঃসঙ্গতা বলা যায়? এর ওজন এত বেশি যে ভার সবাই বইতে পারে না। এ বড় কঠিন কাজ। নিজের একলা প্রহরে যেকোনো মানুষেরই চাই অন্যের সান্নিধ্য, সামাজিকতার যেকোনো অনুষঙ্গ সে আঁকড়ে ধরে খড়কুটোর মতো, মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসার একটু সুযোগ পেলে, হোক না তা ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, তাতেই সে বর্তে যায়; একটু মেলামেশা, সমঝোতার জন্য আকুলতা বাড়ে। হয়তো এ সময় একাকীত্ব আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ যেন অনেকটা নিঃসঙ্গ কিশোরের বেদনার্ত বেড়ে ওঠা, কিংবা বসন্তের প্রথম দিনগুলোর মতো দুঃসহ। তোমাকে যেন তা বিভ্রান্ত না করে। সবকিছুর পরও নিঃসঙ্গতা, অন্তর্নিহিত গভীর একাকীত্বই প্রয়োজন তোমার। আর প্রস্তুতি নাও, অন্তর্যাত্রার। যেখানে তুমি হেঁটে যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, একাকী। তোমাকে এই হাঁটার জন্য তৈরি হতে হবে। যেমনটা হাঁটতে সেই ছেলেবেলায়—  নীরবে, একাকী বসে দেখতে চারপাশের ব্যস্ততা, মানুষের দ্রুত হাঁটাচলা, তাদের এই আসা-যাওয়ার উদ্বেগ দেখে মনে হতো খুব জরুরী কাজে তারা ছুটে চলেছেন। যদিও এসবের কিছুই বোধগম্য ছিল না তোমার কাছে।
       
বড় হয়ে বুঝতে পারলে তাদের সব কর্মকাণ্ডই জরাজীর্ণ; অর্থহীন তাদের জীবিকা, অসাড়তায় ভরপুর; প্রকৃত জীবনের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তাহলে তো বলতে হয়— শিশুর চোখ দিয়ে দেখাই ভালো, এইসব জাগতিক দৈনন্দিন জীবনযাপন, অপরিচিত পৃথিবী। নির্জনতায় সবকিছুকে এই দৃষ্টিতে দেখাই হলো তোমার কাজ, আর এভাবেই বাড়বে তোমার মর্যাদা। আত্মরক্ষা ও লোকজনের অবজ্ঞা থেকে বাঁচতে শিশুতোষ বিজ্ঞতার আড়ালে দুনিয়াদারি না বোঝা থেকে কেন সরে আসবে বলো? এই না বোঝা এক অর্থে নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ও আড়ালে রাখার কৌশল। আর আত্মরক্ষা ও লোকনিন্দা বা অবজ্ঞা হলো এমন কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা যা থেকে তুমি আলাদা থাকতে চাও। 
      
দেখো কাপুস, মনের ভেতরের যে জগৎ তাকে নিয়ে ভাবো, গুরুত্ব দাও, মন যা শুনতে চায়— শোনাও, যা বলতে চায়— বলো। স্মৃতি খুঁড়ে তুলে আনো শৈশবের দিন। ভাব প্রত্যাশা ও ভবিষ্যতের কথা। তোমার মধ্যে যেসব অনুভূতি জেগে ওঠে তার প্রতি মনোযোগী হও। নিজের উপলব্ধিকে গুরুত্ব দাও সবকিছুর ওপরে। তোমার মনে যা কিছু ঘটছে তা তোমার সর্বোচ্চ ভালোবাসার ধন। এসব নিয়েই তোমাকে থাকতে হবে, ভাবতে হবে। এই তোমার পৃথিবী। অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় ও শক্তির অপচয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর অন্যদের নিয়ে ভাবতেই হবে এমনতো কোনো কথা নেই! জানি অনেক কঠিন পেশা বেছে নিয়েছ। নিজস্ব চিন্তার পরিপন্থী অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। আমি আগাম দেখতে পাচ্ছি সেজন্য দুঃখ পাচ্ছ তুমি, জানতাম এমই হবে, এমনটাই হওয়ার কথা। তোমাকে সান্তনা দেবে এমন কিছু বলতে পারছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, পৃথিবীর সব পেশা একই রকম। যা দেয়, নেয় তার চেয়ে বেশি। ব্যক্তির কাছে তার অনেক প্রত্যাশা, বৈরিভাবাপন্ন পরিবেশে, একঘেয়ে, নীরস কর্তব্যপালনে যাদের আগ্রহ নেই তাদের প্রতি নির্মম। যে পরিস্থিতির মধ্যে তুমি আছ তা সংষ্কার, রীতিনীতি, প্রথা, ভুল ধারণা এরকম সামাজিক বোঝার চেয়ে জটিল নয়। কেউ যদি এর চেয়ে ভালো অবস্থান কিংবা তুলনামূলক স্বাধীনতার প্রলোভন দেখায়, জেনো এ স্বাধীনতা কিছুই নয়। সত্যিকার স্বাধীনতার বাস জীবনের গভীর বিস্তৃতির মধ্যে, সব গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর সঙ্গেই তার সম্পর্ক। গভীর নির্জনতায় যার বাস, তার কাছেই ধরা দেয় গভীর কোনো বিষয়ের সূত্র। ভোরে সূর্যোদয়ের আগে যখন সে হাঁটতে বের হয়, সন্ধ্যায় তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, অনুভব করে সবকিছু, যা ঘটছে চারপাশে; এই পুরো পরিস্থিতিই তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে। যেন মৃত কোনো মানুষের হাত থেকে টুপ করে খসে পড়েছে তা; যদিও সে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃত জীবনের মাঝেই।
     
প্রিয় কাপুস, এখন তোমাকে চৌকস পেশাদার ব্যক্তির মতো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। যেকোনো প্রতিষ্ঠিত পেশায় গেলেও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে তুমি। হ্যাঁ, যেকোনো পেশাগত অবস্থান থেকে যদি মানুষের সঙ্গে মেশার সহজ উপায় খুঁজতে, তাহলেও বন্ধনের শেকল তোমার মনে থেকেই যেত। এ শেকল ভাঙা সহজ নয়। এমনটাই ঘটছে সবক্ষেত্রে। কিন্তু এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বা দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। মানুষের সঙ্গে যদি মিশতে নাও পার, কাছাকাছি থাক। অথবা বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে পারো বস্তুকে, প্রকৃতিকে। একাত্ম হও এদের সঙ্গে। মানুষের মতো এই প্রকৃতি, বস্তুরা তোমার সঙ্গে  বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তোমাকে ছেড়ে যাবে না কখনো। জনপদ ও গাছপালার মধ্য দিয়ে যে বাতাস বয়ে যায় তা চিরকালীন, বস্তু ও প্রাণীদের জগতে সবকিছুই ঘটমান, সম্ভাবনাময়; এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারো তুমি। 
     
আর শিশুকাল একই রকম, এই সময়ের শিশুরা তেমনই যেমনটা তুমি ছিলে তোমার শৈশবে। একই রকম বিষণ্ণতা ও আনন্দে কাটছে তাদের দিন। নিজের শৈশবের কথা ভাবো, মনে হবে তুমিও তাদেরই একজন। এখনো তাদের মধ্যেই আছ। আর এ জীবন ছেড়ে বড় হওয়ার কোনো মানেই হয় না। কারণ  সমাজে বয়স্কদের কোনো মূল্য নেই। তাদের মর্যাদাও গুরুত্বহীন। 
    
তবে যদি শিশুকালের কথা ভাবতে ভয় পাও; এর সারল্য ও মৌনতা তোমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তুমি আর ধর্মে বিশ্বাসী নও, বিশ্বাসী নও স্রষ্টার অস্তিত্বে। অথচ তিনি আছেন সবকিছুতেই। নিজেকে প্রশ্ন করো, ভেতরের স্রষ্টাকে তুমি হারিয়ে ফেলেছ কিনা। অথবা এটাই কী বড় সত্য যে তুমি তাকে কখনোই ধারণ করতে পারোনি। এমন কি হয়েছে কখনো? তোমার কি মনে হয় কোনো শিশু তাকে ধারণ করতে পেরেছে কখনো অথবা কোনো শিশুর পক্ষে আদৌ তাকে ধারণ করা সম্ভব?  প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা অনেক সাধনার পর তাকে ধারণ করতে পারলেও এই ভারে শেষ পর্যন্ত তারা নুয়ে পড়ে। তুমি কি মনে কর স্রষ্টাকে পেয়েও কেউ তাকে আবার হারিয়ে ফেলে, কুড়িয়ে পাওয়া কোনো নুড়ি পাথরের মতো? তোমার কি মনে হয় না একবার পাওয়ার পর স্রষ্টাকে ধরে রাখতে পারে না সে তার কর্মফলের জন্যই? 
    
যদি বুঝতে পার তোমার শৈশব ও এতোদিনের জীবনে আদৌ তার অস্তিত্ব ছিল না, কিংবা থাকলেও টের পাওনি। যদি সন্দেহ হয়, মানুষের প্রতি আবেগি বিশ্বাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন যিশু, আর মুহম্মদকে ঠকিয়েছিল তার গৌরব যার ভিত্তি ছিল স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ও মানুষের কল্যাণের চিন্তা; এখনো যদি এই ভেবে আতঙ্কিত বোধ কর যে স্রষ্টার কোনো অস্তিত্ব নেই। যাকে নিয়ে কথা বলছ তার যদি কোনো অস্তিত্বই না থাকে তবে তাকে হারিয়ে ফেলেছ এমন ভাবনার কোনো মানে হয়? এ বিষয়ে তোমার ব্যাখ্যা কী? আমাদের কাছ থেকে যে চিরতরে চলে গেছেন বা হারিয়ে গেছেন, তাকে খোঁজার মতো করে সৃষ্টিকর্তাকে তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ না তো?

এভাবে কেন ভাবছ না, তিনি আছেন, চিরায়ত তার অবস্থান, একদিন ঠিক এসে হাজির হবেন। তিনি সেই পরম বৃক্ষের ফল, আমরা যার লতাপাতা— এমনটা মনে করলেই পার। কেন ভাবতে পারছ না তার জন্ম হবে ভবিষ্যতের কোনো এক নিশ্চিত সময়ে, কালের গর্ভে। চারপাশে তাকিয়ে দেখ, একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবী। পুনরাবৃত্তি ঘটছে সবকিছুর। কোনো কিছুর শুরুটা সব সময়ই সুন্দর। স্রষ্টা যদি সবচে নিখুঁত হয়ে থাকেন, যার ভেতর ঘাটতি থাকে, জীবনের পরিপূর্ণ ঐশ্বর্যে তিনি তাকেই বেছে নেবেন নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে। তিনিই তো সেই জন, সব সুন্দরকে যিনি ধারণ করেন নিজের ভেতর, যার জন্য তৃষ্ণার্ত আমরা। যদি তিনি ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে বিরাজমান থাকেন তাহলে তার কি অর্থ দাঁড়ায় বলো? 
   
মৌমাছিরা যেমন ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায়, আমরাও সেভাবেই জড়ো করি পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এবং এভাবেই আমরা তাকে নির্মাণ করি। এমনকি যা তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, ভালোবাসার মোড়কে জড়ানো, যা কিছু গড়েছি, আমাদের শুরুটাতো তা দিয়েই। এরপর আমরা এগিয়ে যাই শ্রম, বিশ্বাস, আনন্দ, মৌনতায়। অন্যের সাহায্য ছাড়াই যা কিছু নির্মাণ করি তার ভেতরই একান্তে স্মরণ করি তাকে। বেঁচে থাকতে কখনোই তার দেখা পাবো না আমরা, যেমন আমাদের অনেক পূর্ব পুরুষ দেখা পাননি আমাদের, বহুকাল আগে যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখনো তারা আমাদের মাঝেই আছেন, আমাদের ভাগ্যের বোঝা হয়ে, প্রবাহিত হচ্ছেন রক্তের শিরা-উপশিরায়। তারা আছেন কালের গভীরতায়। এমন কোনো শক্তি কি আছে যা তোমার বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করবে, যে তুমি এরই ধারাবাহিকতায় বেঁচে থাকবে তার মাঝে, এবং বিলীন হবে তার মাঝেই, দূরে বহুদূরে, সীমানার শেষ প্রান্তে যার অবস্থান।

প্রিয় কাপুস, এই গভীর ভাবনার মধ্যে কেটে যাক তোমার বড়দিন। হয়তো তোমার মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেই জন্ম হবে তার। তিনি তাই চান। তোমার মনে এখন যা দাগ কাটছে সবই তাকে ঘিরে। তার জন্যই। যেভাবে ছেলেবেলায় তার জন্য কাজ করেছ একাগ্রচিত্তে, নিষ্পাপ মনে। ধৈর্য ধরো, মন থেকে ঝেড়ে ফেলো সব তিক্ততা, যেন তার আসার পথ নির্বিঘ্ন হয়। তার জন্য এটুকু তো করাই যায়! বসন্ত আসার আগে প্রকৃতিকেও তো প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ভালো থেকো আনন্দ ও আত্মবিশ্বাসে।
                                                                                                                                                                      তোমার                
                                                                                                                                                             রাইনের মারিয়া রিলকে


( সৌজন্য - জাহানারা পারভীন অনূদিত  ‘রিলকে নৈশব্দ্যে ও নিঃসঙ্গতায়’  গ্রন্থ)



সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী
                            হিন্দোল ভট্টাচার্য


যোগাযোগ  ও লেখা পাঠানোর ঠিকানা - abahaman.magazine@gmail.com

লেখা পাঠাবেন অভ্রতে। মেল বডিতে পেস্ট করে অথবা ওয়ার্ড ফাইলে। কবিতা কমপক্ষে পাঁচটি পাঠাবেন। আমন্ত্রিত লেখাও অনুমোদনযোগ্য। প্রেরিত লেখা প্রকাশ পাবে কিনা, তা আমরাই মেল করে জানিয়ে দেব। অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই মাস। অনুবাদ পাঠালে মূল কবিতাও পাঠাতে হবে। কোনও লেখার কোনও শব্দসীমা নেই। 

ফিরে পড়া কবিতা- লোকনাথ ভট্টাচার্য



পুনরুক্তির মাঝরাতে
হোক না পুনরুক্তি, তবু নিরুত্তাপ নয় যে-হাতটা বাড়াই তোমার হাতে–যা বলি, ভালোবেসেই। তাই খেদ নেই একই অরণ্যে-পথে, নিশীথিনীর শব্দহীন গন্ধহীন তমিস্রাতে আমি মশগুল স্নেহাকুল বুকে-বাজা ভোর নিয়ে, পাশে তোমাকে নিয়ে।
যেমন তোমারও, পা দুটোই আমার, পথটা তো নয়–তাই হোঁচট যদি খাও, রক্ত ঝরে, তো দোষ দিও পথেরই কর্তাকে। তুমি তো জানোই জানি, অরণ্যটাও আমার সৃষ্টি নয়, রাতটাও নয়। বুকে বাজে ভোর, দেবি, বুকে বাজে ভোর–শোনো, আমাদের পায়ে-পায়ে যে পৌঁছাতে চাওয়ার গান।
ক্লান্তি তোমার স্বাভাবিক, আমারও, এ-হাওয়াহীনতা গলা টিপে ধরে। যোঝার অস্ত্র শুধু ভালোবাসা, সেই নিশ্বাস তোমার-আমার–আর কী বলব এই রাতে?
অতএব হাত দাও হাতে, ফেলে যাবই এ-নিসর্গটাকে, পৌঁছোবই যেখানে অন্ধকার ক্ষীণ হয়ে আসে, গ্রামের প্রথম মুরগীটি ডাকে। তার একটু পরেই তোমার কপালে যেমন, আকাশেও লাল টিপ–গোলাপি আলোয় ধৌত মুখে অবশেষে বসব আঙিনায়।
বুকে বাজে ভোর, দেবি, বুকে বাজে ভোর।

অক্ষর হ’ল নদী
আমার নয়, অক্ষরের। মুক্তি আমাতে। নদী। চলেছে। তা শুধু বাড়াল বোঝা দুর্ভেদ্য অন্তরালের, পাষাণ জগদ্দলের, অচল, যাও আমার। একবার বলি, এইবার দরজা-খোলা, খিড়কি প্রস্তুত খোলার জন্যে, আমার হাতে । অন্যবার বলা বৃথাই, বলা আত্মার কান্নায়, খোলো দরজা–বলি। কাকে?
এই সৃষ্টি, দুটি হাত, আমার। আর ফুল ফোটে নির্লজ্জ। আর প্রিয়া ভালোবাসে। আর, ভালোবাসি ভাইকেও, কাছের, দূরের । কোলের পৃথিবী, যেন নারকেলের খোলের পৃথিবী, আবার যে-পৃথিবী দূরের, দোলে, এই এক মুঠোর বুকে।
আজ যদি ফিরে যাই সন্ধ্যায়, যদি না-ই যাই, তবে?
অক্ষর মুক্তি পেল আমাতে, রূপ দিতে অক্ষরকে।
ফিরে আমি যাব শেষে আজো সন্ধ্যায়, কারণ আমায় ফিরতে হবে, আবার চলার আগে, আবার ফেরার আগে। (কাল সকালে সূর্যোদয়, ফুল ফোটা, প্রিয়ার রাত্রির পরে) কারণ আনাগোনা, নিয়তি, মানুষের । ফেরার নয় অক্ষরের ।
ভাই, হাঁপিয়ে পড়েছ? আমি পেতে দেব আসন। আমি এনে দেব মাদুর, মেদিনীপুরের। দেব? ভাই
অক্ষর নদী হ’ল আমাতে। সে এখন বাঁচে আপনার স্বত্বাধিকারে।
মুক্তি কেন দেবে স্বাদ বন্ধনের? কোন মুক্তি মানবে না কিছুই, মুক্তি ছাড়া? ভাই, তুমি কেন হও না অক্ষরের?
বারবার চেয়েছি বাজাতে, যে-সংগীত তোলার ছিল, আজো তোলার আছে, আমার ঘরের বীণায়, যে-একই সংগীত বাজে দিনের, রাতের, দিনেরাতের ওপারের আঁধার বীণার তারে। এদিকে অক্ষর হ’ল নদী–আমার ধ্যানের সন্তান, আমাকে উল্টে ফেলে দিয়ে, আমাকে অস্বীকার ক’রে, ঐ চ’লে গেল সে, ঐ চ’লে যায়, আর নয় আমার ধরার, ছোঁওয়ার নাগালে।
সে পেল, পায়, যেখানে সব, সে-জগতে অন্য সূর্যাস্ত দিনশেষে–আমার, আমার প্রিয়ার চোখে তার আলোক পড়বে না।
এখানে–রইল স্বাদ শিকলের। নয় শুধু নির্বিশেষে শিকল, নিরুপায়, তার, নদীর অভাবের–কিন্তু এক অন্যতর শিকলের, যে প’ড়ে রইল ঐ স্বৈরিণী স্বয়ংবরা নদীর অবহেলিত কামুক, আক্রোশে।
ভাই, তুমিও রইলে সঙ্গে। তুমিও বুঝেছ। আর বলা কেন?


কৌটোর গল্প
ভ্রমণের পথ যেহেতু একই, রোজই, এভাবে যাত্রার বর্ণনা দিই কেন বার বার – এই তো প্রশ্ন?
উত্তর হল, সংখ্যার প্রতি আমার প্রেম।
যেন গম্বুজটা তিনবার আওড়ালেই তিনটে গম্বুজ হল, বা তিন কনে-দেখা আলোয় তিনটে ময়ূর হল, তিনটে তুমি হলে।
যেটা বলি না, কোনোদিনই না, সেই মনের গহনে সযত্নে বহন –করা কৌটোর ভীষণ অন্ধকারটাও তিনগুন হল।
আমি যে আজো আশা করে আছি, হে সুডৌল স্তনের মহিমা, আমরা ব্রমণে চির-সঙ্গিনী, একদিন নিজেই তুমি উদ্ধার করবে আমায় বার-বার এই একই ইঁটের সাজানো পিরামিড হতে, অবশেষে ঐ কৌটোর গল্পটা শুনতে চেয়ে।

মধ্যরাতে কবির উক্তি
আমরা সেই তারা, গত সূর্যাস্তের উল্কি ছিল যাদের গায়ে ও যাদের কোন ভ্রমে পারদর্শী নট ভেবে রাজার প্রহরী ধরে আনে দরবারে –ঝাড়লন্ঠন জ্বলে ঊঠেছিল তখনই, কারণ সন্ধ্যা হয় হয়।
রাজা বসেছিলেন ফ্রেমে-আঁটা ছবির মতো, ঢুলু ঢুলু চোখ, গোঁফে আঙুল চালিয়ে বলে ওঠেন, কী পার দেখি, কিছু তামাশা হোক।
দলের এই অধমই সেই সর্দার, অসভ্য অশোভন উক্তির সাহসে যার জুড়ি নেই, বলে উঠি, খেতে দাও-একবার, দুবার, পর পর তিনবার, তৃতীয়বার এত চেঁচিয়ে, হুমকি দিয়ে, যে হয়তো নিজেও চমকে ঊঠি, নাই বললাম মণি-মুক্তার পাখি বসানো সে মসৃণ মর্মর দেয়ালের বিড়ম্বনা।
রক্তচক্ষু রাজাঃ- ‘তবে এই বুঝি তামাশা তোমার?’ দে ছুট, দে ছুট, সঙ্গীদের নিয়ে, প্রহরীরা জাগবার আগেই-ফটক পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে এখন এই অন্ধকার অরণ্যের গহনে, হন্যে হয়ে মধ্যরাতের দূরশ্রুত হায়েনার হাসির হাহাকারে হঠাৎ-হঠাৎ -কে কার খাদ্য কে জানে।
প্রহরীরা পিছু নিয়েছেই। জানি এবার যদি ধরে, আর দরবারের জন্য নয়, তা হবে রাষ্ট্রের শত্রু বলে কারাগারেই পুরতে।
সূর্যাস্তের উল্কি ছিল গায়। ভোরহীন গ্রামহীন হে অরণ্য এই, হে মধ্যরাত, আমাদের এই এক কবিতার সময়।
ছায়া
মুখোমুখি মৃত্যুর, মুখোমুখি রক্তের, মুখোমুখি জীবনের। আমারি মৃত্যুর, আমারি রক্তের, আমারি জীবনের।
আর এই দিগন্ত, দিনান্ত, বনান্ত।
আর এই কে বলে গেল স্বপ্নের কথা, ফিসফিস করে, খোলা হাওয়ায়? বলে গেল হঠাৎ। যেন আরো আছে এসব ছাড়িয়ে, আরো হাহাকার আনন্দের ও বেদনার, ও ব্যর্থতার- মধুর,মধুর ব্যর্থতার। যেন একটি অপেক্ষার, নিরীক্ষার প্রান্তর, যে চেয়েছে হতে ধানখেত অনাগত অন্য এক সূর্যাস্তের সুষমায়।
শুনলে কি গঙ্গা ধমনীতে? শুনলাম কি?
বন রইল বাঁ হাতে, মাঠ রয়েছে সামনে- যে আরো আছে ছাড়িয়ে এসব, তারি মধুর, ব্যর্থ,অনিবার্য পান্ডুলিপির মত। মাথার উপরে আকাশ হতাশার, আশার, দুরাশার। চোখে আমার দূর সপ্তর্ষির ঘ্রাণ,ইতিমধ্যেই। প্রিয়া তার যর্থাথ অন্তঃপুরে,অর্থাৎ অন্তরে আমার। বিহ্বল, বিলীন, অথচ জাগ্রত।
আমি এক মানুষ নামহীন, ক্ষীণকায় – তবু এই অল্প আলোয় আমার ছায়াও পড়ে গেল পাশের ভাইয়ের উপর, সেও চলেছে।

অনুক্ষণ সেই রাধিকা
অনুক্ষণ সেই রাধিকার কথা মনে হয়, যে একবার, কেবল একটি লহমারই জন্য, কী
ভেবে, বা কিছুই না ভেবে, চলতে-চলতে থমকে দাঁড়িয়েছিল, রাত্রি যখন ডানা-মেলা
ঈগলের মতো আকাশে-আকাশে,
সেই অভিসারিকা, যার হঠাৎ-স্থির গোড়ালি বুকে ধরে চিরকুমার মাটীর পৃথিবী হতে
চেয়েছিল মধ্যযুগীয় গীর্জার গাত্রে-খোদিত নতজানু যাজক,
আর যেন-অনন্ত খরার পর বৃষ্টি ঝরেছিল আমার শিরায়-ধমনীতে, রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা
এই বুঝি বেজে উঠল-উঠল শঙ্খধ্বনি, বাতাস পেল-পেল প্রাণ,
অনেকে যারা দ্বার-খোলা মাদুর-বিছানো ঘরে এসেছিলেন সেদিন, এমনিতেই,
বসেছিলেন কোনো প্রত্যাশা না করেই,
তারাও নিমেষে সে-কী করজোড় ভাস্কর্য, যাদুর মন্ত্রে উদ্ভাসিত কপাল–
যদিও হল না কিছুই, শঙ্খ বাজল না, চকিতে গতি ফিরে পেয়েই সে-নারী হারিয়ে গেল
দেওদার-অরণ্যে, পরে হয়তো দিগন্তে নীল রেখার মতো ভাসমান আরো-দূর পাহাড়ের
উদ্দেশে-উদ্দেশে।
শুধু প্রস্তুতির মুহূর্তটি আমিই আজও সাজিয়ে রেখেছি রেকাবিতে, দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস, ওরাও নিত্য-নিয়মিত আসছেন, তাই খোঁজখবর দেওয়ায়-নেওয়ায়
আমার কুটীর কলগুঞ্জনময়,
আঁধারে বিদ্যুৎ খেলা করে যায়।

বিকলাঙ্গ
কনুই-এর গুঁতো খেতে-খেতে এসে থেকেছি একটি ধূলিকণায়, জানি না তাতে স্বর্ণ
আছে কিনা, অথবা তা গোবরের ভস্মীভূত অংশ, কিম্বা তিন দিন আগে মৃত
উইপোকারই পিঠের ছালের একটুখানি।
অন্যের শরীরের প্রশ্ন উঠল বলেই এটাও জানানো ভালো, আমারও চোখটা-নাকটা-
ভুরূটা কে কোথায় যেন ক্রমশই কেড়ে নেয়, চোয়ালের খানিকটা কোন গিরগিটি
খাবলে নিয়ে গেছে, হাঁটুর কাছে গর্ত, যা দিয়ে শিরশির হাওয়া ঢোকে হাড়ে।
আমরা চোখটা আছে কোথায়?–ঐ দেয়ালের ছবির ফ্রেমে। নাকট্য?–কুলুঙ্গির
কৌটোর ভিতরে। ভুরূটা ?–ঐ-যে খড়টা হঠাৎ-হঠাৎ নড়ে-চড়ে, ঘুরে বেড়ায় এ-কোণ
থেকে ও-কোণে, তাইতে।
যদিও ভেবেছিলাম এসবই আমি বিলিয়ে দেব, সানন্দেই, জড়কে নয়, প্রাণের
জোয়ারে–ওঁ স্বাহা বলে ডান পথিকের ঘামকে, তোমার উচ্চারিত নামকে।
তাছানা ত্রিভুবনের অপ্সরী, সেই তুমিও তো স্বয়ং বসে রয়েছ সামনে, উরু-দুটি ফাঁকে
করে, আমাকে নিয়ে শয্যায় উঠে যাওয়ার আশায়,
যখন বাহাত অক্ষত হয়েও আমি সর্বাঙ্গে বিকলাঙ্গ, ফুঁ দিলেই ধ্বসে পড়ে যায়-যায় ঘর।
তাই ভাবনা, অবশেষের এই-যে ধূলিকণা, তাতে স্বর্ণ আছে কিনা–এমন যাদু যা
ফিরিয়ে দিতে পারবে হারানো অঙ্গগুলি।

উপরন্তু যার পুরুষাঙ্গ
আমাকে এইবার সেই কথা দাও যা নয় রাংতার বাক্সে মোড়া, রঙিন ফিতে-বাঁধা,
বড়লোকের খোকার জন্মদিনের টেবিলে মিষ্টি হেসে আলতো করে রাখার জন্য আদব
কায়দায়।
আমাকে এইবার কথা দাও যা উলঙ্গ তো বটেই, উপরন্তু যার পুরুষাঙ্গে হয়তো
সবেমাত্র গনোরিয়া ধরেছে, বা হয়তো গিয়েছিল প্রেমিকার দরবারে, ফিরে এসেছে
উপহাসের চাবুক নিয়ে মুখে, যে আবেদন করেছিল খোলা-বন্ধ সব দরজায়, তবু চাকরি পায়নি।
যার আঙুলগুলো বেঁকে গেছে ক্রোধে-গ্লানিতে-অনুশোচনায়, যে ছটপট করছে জ্বলে
উঠতে চেয়ে, পারলে ঝাঁপিয়েই পড়ে সাততলা বাড়ী থেকে,
পথে-দেখা বসন্তের-আঁচল-মেলে-দেওয়া সুন্দর-সুন্দর পটের বিবিদের স্তনগুলো
যে চটকে ছিঁড়তে চায়।
আমাকে কথা দাও এইসব ভাবতে পারার, বলতে পারার, পরে অট্টহাস্য ফেটে
পড়ার, না-হয় কনে-দেখা আলোরই গম্বুজ নিয়ে সামনে,
না-হয় এখনই, যখন তুমিও এক আশ্চর্য স্তনেরই রমণী, ঈপ্সিতা প্রেমে ও প্রত্যয়ে,
পাশেই রয়েছে বসে আপাত-শান্তির স্ফটিকের প্রাচীরে নিজেকে ঘিরে।

আমার মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা
আজ যারা চল্লিশ বা কাছাকাছি কোঠায়, আমার সমকালের সেই কত খোকা-খুকুদের
বলতে শুনি চোখ কপালে তুলে, নৈরাশ্যে-অবজ্ঞায়, “বাবা গো, কালে কালে দেখব
কত, কী অমানুষ হচ্ছে এই ছেলেমেয়েগুলো, কী অরাজক যুগ!”
আমি তো বলব, আবার যদি জন্মাতে পারতাম তোমাদেরই কালে, তোমার সঙ্গে এই
সকালসূর্যকে চুমু খেতে।
দেখছি তো, তোমরা শিখছ কত এই অল্প বয়সেই, শক্ত-শক্ত বীজগণিত-পাটীগণিত,
জৈব ও পদার্থ বিজ্ঞান–প্রাণের রহস্য, ফুলের সংকেত, আমরা তত শিখিনি। সময়
হলে ভালোবাসার যে-অট্টালিকা তুলবে, আমাদের বাড়ি থেকেও তা হবে অনেক সুদৃঢ়
কারণ ভিত্তি আরো গভীর।
আমি তো বলব, আবার যদি জন্মাতে পারতাম তোমাদেরই কালে তোমার সঙ্গে এই
সকালসূর্যকে চুমু খেতে।
তোমাদের ভোর এসেছে এক অন্ধ রাত্রির পরে, যার কিছু সাংঘাতিক কুয়াশা জানি
এখনো লেগে রয়। তাই পথে নামার অটুট প্রতিজ্ঞা তোমাদের, শত্রুর সঙ্গে এস্পার-অস্পার
যোঝার কী মরণপণ! বিশ্বাস করো, যা দেখেছি জ্বলজ্বল তোমাদের চোখে,
আগামী পথের অগ্নিসম্ভব দায়িত্বের এত বড় জ্ঞানে আমরা জাগিনি কোনোদিন।
আমি তো বলব, আবার যদি জন্মাতে পারতাম তোমাদেরই কালে তোমার সঙ্গে এই
সকালসূর্যকে চুমু খেতে।


বাইরে-ভিতরে বন
বাইরে তাকালে বন, ভিতরে তাকালে বন। এখনো দুটো দুরকম।
একটা শাল-তমাল-দেওদার, রৌদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ, ছায়ায় সুনিবিড় কোণগুলিকে
পোকামাকড়-পিপীলিকার আনন্দ। অন্যটায় নাম-না-জানা অন্ধকারের বসা, মণি-মুক্তার
হঠাৎ-হঠাৎ দ্যুতি।
তবু চোখ খোলায় ও বোজায় যে-কসরৎ, তাতে ইতিমধ্যেই ধীরে-ধীরে একটি
রসায়নের প্রক্রিয়া শুরু, লাল গেলাসে নীল মদ ঢালা। শাল-তমাল-দেওদারে মণি-মুক্তা,
অন্ধকারের বর্ষায় রৌদ্রে।
বাইরে তাকালে তুমি, ভিতরে তাকালে তুমি। এখনো দুজন দুরকম।
একজন গৌরবর্ণা, নাকে নোলক, পরনে ধনেখালি। অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গী, হাতের কাঁকন
ভিন্ন অলংকার নেই দেহে, পরনে বেনারসী।
তবু ধীরে-ধীরে গৌরবর্ণার হাতে কাঁকন, কৃষ্ণাঙ্গীর নাকে নোলক–এক মোহনার
জল।
অপেক্ষা করছি আরো কতক্ষণ লাগবে দুটিতে মিলে সম্পূর্ণ এক হওয়ার, দ্বন্দ্ব ঘোচার,
পরে বহুদূরের যে-যাত্রীর দাঁড়িয়ে রয়েছে খেলা শেষ হওয়ার, তাদের সঙ্গে এ-
ঘরের ঐক্যকে বিদায় জানিয়ে
আমরা দুজনে বেরিয়ে যাব পরম বৈরাগ্যে।

কলকাতায় আজো বসন্ত
মনে টাটকা কৈশোরের মতোই, সারা বিশ্বে নোংরার প্রথমা প্রধানা রাণী কলকাতায়
আজো বসন্ত আসে–কৃষ্ণচূড়ার একই সমারোহ।
জাপানী যদি হতাম, গোটা তিনদিন তিনরাত ধ্যান করতাম সামনের কৃষ্ণচূড়াটার, তার
ফুল-পল্লব-প্রমত্ত রঙের রহস্যের, পরে আরো ঘণ্টা দুই সময় নিয়ে বাহারের কত রকমারি
কাটাকুটির পর সংক্ষিপ্ত আন্তরিক যদিও প্রথামতো অতি অর্বাচীনই চারটি লাইন লিখতাম,
এই যেমন
‘বসন্তে কৃষ্ণচূড়ার রঙ কী সুন্দর’ ইত্যাদি ইত্যাদি;
ও শেষে দীর্ঘ তৃপ্তির নিশ্বাসে বুকে ঢেউ তুলে উঠে পড়তাম–ধীর পা স্নানের ঘরের
দিকে–জীবন নিশ্চিতভাবে ধন্য জেনে।
এবং কে জানে, হয়তো পাঁচশো বছর পরে এক পুরাতাত্ত্বিক সম্পাদকের কোনো
ইউনেস্কো-সুলভ সংকলনে সে-কবিতা স্থান পেত টীকাসমেত, নামটা থেকে যেত।
অতএব এখন বুঝছ তো, আক্ষেপটা কোথায়?
কারণ উল্টে কৃষ্ণচূড়া, নিসর্গের চাবুক-কষা পরিহাস, আমার শহরের এ কী দিন এনে
দিলে দরজায়–সব কথার স্তম্ভিত অর্থহীনতার, ধেই-ধেই মৃত্যুর মুকুট-পরা-শির অন্য
আরেক কবিতা।


প্রৌঢ়া প্রেয়সী
এ-ব্যাধি বহুকালের। তাই ছেলেবেলায় যখন কবিতা লিখতাম, মাঝে মাঝে বিশ্বাসের
কথা বলেছি। আজ আর বলি না, কারণ হয়তো বয়স হয়েছে, পৃথিবীর ক্রূর
পাঠশালায় শিক্ষিত হ’য়ে বুঝেছি, বিশ্বাস ব’লে জিনিস নেই। তাই অবিশ্বাসও নেই।
আর সবই আছে, আমাদের সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, বৃষ্টি-ঘাম-রোদ্দুর, তোমার চোখের চাওয়া,
খাওয়া আর পায়খানায় যাওয়া–দিনের পথে ঘোড়দৌড়, রাত্তিরের ঘুম। পায়খানার
নিত্য নৈমিত্তিক কোঁৎ পেড়ে চালান দেওয়া বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যত তর্ক, গতকালের
খাবার–আর আজকের খাবারের জন্যে প্রস্তুত হওয়া।
ছেলেবেলাকার সেই বটগাছটা যদিও আজও সমৃদ্ধ, জানি আর বিশ্বাস নেই সে-
বুড়োটারও। আমরা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঝিমোই।
মনে কোরো না এ কোনো সাবেকী দুঃখবাদী বক্তব্য–ঐ দুঃখটাও যদি থাকত তো
হয়তো বেঁচে যেতাম। আসলে বক্তব্যই নেই। আর–মনে পড়ে ? সেই মানুষী
করুণার দুটি গোলাপ আমার দুই হাতে দেবে বলেছিলে একদিন, তখন আমরা কিশোর
কিশোরী, দাওনি কেন? না প্রৌঢ়া প্রেয়সী, তুমিও সমানই অসমর্থ?
তবু পৌঁছোতে হবে মন্দিরে, পৌঁছোতে যে হবেই রাণী, কেন এই অকথ্য অবোধ্য
অভিপ্সা আজো আমার হাঁটুর অন্ধকার থেকে থেকে আকুল করে!

প্রেমের ও প্রেমাতীতের
বলতে হবে কেন এলাম?
এক পলক চাওয়ায় হানব সূর্যের রশ্মি ঐ শেওলা-পড়া দরজার বুকে–আনব ডেকে
যে-মন্থরতা মদিরতা রাত্রির, উন্মত্ত কোলাহলে।
যা ছোঁবে, তার সব হবে না আর পাথর; কান পাতলে শুনতে পাবে তাতে যোজন
দূরের কল্লোল, ক্রমাগতই এগিয়ে আসা।
আর সেই যাদু ঘটাতে গেলে একলা আমার আসা হবে অর্থহীন–এই আসা পাড়ি-দেওয়া
রাত্রি-অরণ্য-মরু (কেন ? কেন ?)–যদি না ঐ পদ্মচোখ তুলে তুমিও তাকাও,
দ্যাখো অতিথিকে।
জেনো আমার ফিরে যাবার নেই পথ, আসিনি ফিরতে।
এসেছি রিক্ত হাতে। ফুল গেছে শুকিয়ে আগুনের হাওয়ায়, দীর্ঘ যাত্রায়। শুকায়নি লগ্ন।

সে আমায় দিয়েছে
সে আমায় দিয়েছে এক আশ্চর্য আগুন-আমায় দিয়েছে সেই আগুনে অনির্বাণ জ্বলার মত তেমনি বিরাট এক অন্ধকার। তাতে প্রতি মুহুর্তেই খুলে গেল পথ, জ্বলে গেল বুক। তবু তাও শেষ নয়।
আমি বলি তাই তারই কথা কখনো চুপ করে, কখনো গুমরে গুমরে,কখনো মরতে মরতে, জ্বলতে জ্বলতে। এই পাথেয় অশেষ, আমায় মুক্তি দিয়েছে, দাস করেছে অসহ্য নিয়তির, এ আমার মস্তিষ্ককে চিরবিমূঢ় করে দিয়েছে একেবারে জন্মের মূহূর্তেই, অবাধ্য আভায়, অকাট্য আঁধারে।
আমি কেবল ছুটব, হাঁপাব,মুঠো-মুঠো ভরব অন্ধকার, ছুঁড়ে দেব আগুনে। আর আগুন লেলিহান হয়ে শত শত প্রসারিত করে তাকে গ্রাস করবে অট্ট হেসে।
এই পোড়া মাটিতে যে-ফুল ফোটাই আমার বেদনায়, সে আগুনের ফুল- টেক্কা দেয় কোটি যোজন দূরের তারার সঙ্গে। আকাশ তাকে দেখবার জন্যে হয়েছে পাষাণ-শতদল-মুখ ঘুরিয়ে বিস্ফারিত সে চেয়ে আছে তলার দিকে, বোঁটা তুলে অদেখা শূন্যে।


যাকে বাঁধতে চাই, ভালোবাসতে চাই, যার রূপ গড়ে তুলি মনে-মনে, তাকে বৃথাই ডাকতে চাই একটু মূহূর্ত ধরে, এই অনন্তে জ্বলন্ত রাতের কারখানায়।

ফিরে পড়া কবিতা - শম্ভু রক্ষিত





যুত-যৌগ-তন্ত্র

আমার স্বরযন্ত্রের ঠিক নিচের থেকে গঠনকারী ক্ষীণ মূল শ্বাসনালী
আমার হৃদপিন্ডের মুখে নেমে এসে অণুস্তরে পৃথক দুই ক্লোমশাখায়
গঠনাকৃতি নিয়েছে
আমার নরম হাল্কা ক্লোমশাখা-দুটি ডাইনে বাঁয়ে এগিয়ে
তড়িৎধর্মী শাখা প্রশাখায় ভাগ হয়ে
আমার দুই ফুসফুসের দুই দিকে ঢুকে
আমার শরীরের নানাস্থানে ধর্মোদেশ দিয়ে বেড়াচ্ছে;
তারা আমার মূল শ্বাসনালীর মতো উত্তেজনাপূর্ণ-ফাঁপা রয়েছে

আমার স্থিতিস্থাপক তন্তু দিয়ে আমার সরু সরু নলগুলো তৈরী
তাদের আজ মাইক্রোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে আমাকে দেখতে হচ্ছে
খুব কঠিন দেখালেও এরা হাড়ের তৈরী নয়
এগুলি কচকচে ধরনের একরকম উপাস্থি দিয়ে তৈরি
আর তারা এস-পি-ডি-এফ উপাস্থি দিয়ে গঠিত
তাদের নির্দিষ্ট আকার আছে
আর তারা কেলাসাকার বা বর্তুলাকার

আমার পাতলা মাংসপেশী কখনো চুপসে যাচ্ছে না
কেননা আমার শ্বাসনালীর প্রশাখা আমার ফুসফুসের থেকে
অনেক দূরেই রয়েছে
আমার ফুসফুসের বায়ুকোষ পর্যায়ক্রমে একবার করে
চুপসে গিয়ে বায়ুশূন্য হচ্ছে
আবার ফুলে উঠে দিব্যি ব্রম্ভ্যবিদ্যা শিখছে

আমার সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম ব্রংকলগুলি যদি সংখ্যা গণনা করা যায়
তাহলে প্রত্যেক দিকে সংখ্যা হবে আড়াই কোটি
আর বায়ুকোষের যুক্ত ইনফণ্ডিবুলামের সংখ্যা গণনা করলে হবে
প্রায় চল্লিশ কোটির বেশী

আমার স্বরযন্ত্রের বাক্সের মধ্যেই দুই পাশ থেকে দুটি ঝিল্লির পর্দা
আড়াল টানা আছে

তার মাঝখানে একটু ফাঁক
বলা বাহুল্য আমার স্বরযন্ত্রের বাক্সটি বা আমার ভোকাল কার্ডের পর্দাগুলি
রৌপ্যবৃক্ষের আকারে সরুমোটা হয়ে অবস্থান করে
আমাকে চিহ্নিত করছে...


সেই ঘাসওয়ালা

সেই ঘাসওয়ালা
তার ভাষায়, ঠিকমত কালো, পাতলা
বুজুকুশাস
জীবানু গজাবার উপায় খুঁজছিল

সেই ঘাসওয়ালা
তিনপায়ে দ্রুত ছুট লাগিয়ে
ভূঁই-এর প্রায় অর্ধেকটা খেয়ে ফেলেছিল

বিস্ময় ০০০ তার দেহ থেকে গজাচ্ছে
তিনটি অপ্রতিহত দ্গদগে লালচে মাথা
সংলাপঃ নিয়তির বচনের সঙ্গে জ্বলতে থাকছে

পদহীন শিশু
ভিখিরি ও মাছির তাড়া খেয়ে
কখনো ছুটে
ঘন ঘিঞ্চি বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ছে

কখনও আওড়াচ্ছে;
আলাউকম আবশো আমহারাঞ্চা আউকাল্লে
সেই ঘাসওয়ালা

আর হাতির শূঁড় যাদের গলায়
যাদের কাছে শিলমোহরের কোন গরু নেই
তাঁবুর আচ্ছাদন বিছিয়ে
তাদের জন্য ছায়ায় আশ্রয় তৈরী করছে
সেই ঘাসওয়ালা

সেই ঘাসওয়ালা
টুকরো টুকরো মেঘেদের ভর করে মরিয়া রহস্যে ফুলছে
ষাঁড়ের চামড়ায় তৈরী শাদা ঢাল নিয়ে
অনেক জলাশয়কে ঘিরে ধরছে

চিন্তন

আমি ভেবেছি আমাকে ঘরের দেওয়ালে বিভিন্নভাবে
স্থাপন করে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করব।

আমি আজ নিরস্ত্র, অযুগ্ম, ত্বরমাণ।

আমি আমাকে আত্মসাৎ ও আক্রমন করি
দ্বিধাহীন ভাবে সমস্ত কিছু প্রকাশ করে দেখাই
আমি আমাকে থামিয়ে রাখি, অপরিবর্ত আকার তৈরি করি
আমি আমাকে দেবতার, পর্বতমালার
বা জড়পিন্ডের  ঋজুরেখা তৈরি করতে কখনো দেখিনি
ধ্রুব বিশ্লেষণ ও স্থির বিষয়বস্তুতে আমি ক্লান্ত।

আমি বস্তুতে আমাকে দেখছি না
আমার হাতের একটা ছোট পেরেক সেই আমাকে দেখে যাচ্ছে
আমার ভেতর  হালের কলাকৌশলের দেদার অনুপ্রবেশ ঘটেছে
অসংখ্য বিশ্বাস, সূর্যের যোজনা, অকৃত্রিম অস্তিত্ব, আলজিঘন কালচে পাথর
বড়বেশী অর্থবহ ছবি, মধুর বিহ্বল কারুকার্য সচেতন হয়ে আমরা মধ্যে আসছে
প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বৈচিত্র্যসৃষ্টি করা উদাহরন
বৃত্তাকার গতিশীল পাহাড়
আমি চিন্তা ও নিষ্ঠার শুদ্ধ পার্থক্য দেখাই স্বচ্ছ পাথরে
উত্তর হতে দক্ষিনের অভিযোগো নিবদ্ধ করি
প্রতিরূপমূর্তি আমাকে দেখে ফেলে
ও মুখোমুখি কাষ্ঠখণ্ড

আমি লাল রঙ পরিমিতভাবে সূর্যকিরনের মত সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছি
শঙ্কুর মত ধূসর ছাইরঙের কিছু গ্রাম,কিছু শহর দেখা যাচ্ছে
গড়িয়ে পড়ছে রঙিন ঘাসের ঘোড়া
আমি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি-অনুসন্ধানযানের ওপর শুয়ে প্রতিধ্বনি খুঁজছি । 
   

পুনরাবৃত্তি

চারপাশের রিক্ত হৃদয় চিৎকার করে এসে দাঁড়াল গোচারনভূমির উপরে।
প্রত্যেকবার আমার পাশ বেয়ে প্রদর্শিতমুখ অভিশপ্তের উন্মুক্ত প্রার্থনার মত
বিবস্বানের নির্দেশে স্বতন্ত্রভূমি তৈরি করল ।

এক শ্বেত কুষ্ঠরোগিনী শতছিন্ন পোশাকের তলায় হাত ঢুকিয়ে আমার শরীরে
উচ্ছ্বাসের সংলাপ ঢালছিল। তার বৈশিষ্ট্য সমর্পিত, পরিপূর্ণ এবং তার
প্রশ্নকটি আমার কাঁধের ওপর হয়ে দিনের উষায় জঠরাগ্নি নামাচ্ছে।
পিতলের বাতিদানের চিহ্ন ধরে এসে গান গেয়ে ক্লোম জাগল।
মিশ্রিত ধ্বনি অবলীলাক্রমে এক একজন নৃত্যাঙ্গনা নোংরা আর উকুনভর্তি
নারীর মেঘবেশ্ম শাড়ির  ছোট ছোট ঘোড়াদের ওপর পশুর গলা বানিয়ে ফেলল।
সবই বেসুরো। অপরিণত । স্বচ্ছন্দ ।

তিনজন আবকার আমার ঘরের মেঝেয় বসে হিজিবিজি বানাচ্ছে।
সামান্য আগে জানলাম। আমি তখনো আমার হয়ে ওঠেনি। নির্দিষ্ট।
মৃতদের বিস্ময়কর শক্তি দেখে আমার ভীষন রোষ হলো। আমি রাসায়নিক
তন্তুর কাছে অনেকদিন কাউকে গলে যেতে দেখলাম না। কোন মানুষ
ছায়া হতে পরিবর্তন এল। অপিঙ্গল বাতাসকে আমি কি করে
সম্বোধন করব!আমার আপশোস থাকল।

সুখের ক্ষীণ শব্দের মধ্যে আমার চাবুক এবং
 চিরন্তন যেন জাহানের চিত্রের ঘাড় বেঁকিয়ে রূপান্তরিত। আধুনিক ।

অনেকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সহগামিনীরা বেগবান জলোচ্ছ্বাসের মত
এগিয়ে এল। ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে নাচতে লাগল। আর প্রত্নতত্ত্ব ভূতত্ত্ব ও
আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের শাসন করে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
আমার শূন্য যন্ত্রনা। আমার অজ্ঞেয় হৃদয়ে ধারনার আইনঘড়ি । প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাদের নিরুদ্দেশ যাত্রায় ষাঁড়ের ও মেষশিশুর অবসর।

সবই নির্ব্যাজ নিকুঞ্জের বাইরে এসে পড়ল। দেখল মাটির ওপর
বিচ্ছিন্নতার ভেতর আমি পরিপূর্ণতা জুড়ে রয়েছি। আমার অভিসন্তাপ মুখ
দেখা যায়নি। আমার উদ্ধ্বত মুখ, শুদ্ধ, উন্মুক্ত, অভ্যর্হিত ।

এফিডেবিট

আজ আমার বরাদ্দ একটা প্লেটে শক্ত রুটি আর অদ্ভুত পাঁউরুটি আর গরুর
ও শূকরের মাংস আর সালতি আর চা কফি আজ সি~বি~আই এর খবরদারির
মধ্যে আছি আজ কাঠের খটাং খটাং শব্দ-করা ডি এফ লিফটে চড়ে নতলার
ঘরে এসে আমি পৌঁছেচি আজ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলাকে দেখা গেছে
মোজাম্বিকের আদি প্রেসিডেন্ট সামোরা ম্যাচেলের ঘরনী গ্রাকা ম্যাচেলের
সঙ্গে আজ কলকাতার অফিস পাড়ায় একটি বেসরকারী লকার কোম্পানীর
মালিকদের এক শরিক কোম্পানির ন-হাজার গ্রাহকের ভল্টের চাবি পকেটে
নিয়ে বিদেশে যাওয়ায় আমার এক আত্মীয় চূড়ান্ত সংকটে পড়েছে আজ
কলকাতার মুক্তারামবাবু স্ট্রীটের মল্লিকবাড়ি থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হবে
তাতে পালকি ঘোড়ার গাড়ি পুরনো দিনের গাড়ি থাকবে শোভাযাত্রা শেষ
হবে আলমগীরের পৌত্র ওসমানের সমাধিস্থলে আজ প্রয়াগে একটি সতীদাহের
ব্যবস্থা করা হয়েছিল আজ মুম্বাইয়ের স্টেট ব্যাঙ্কের ডেপুট ম্যানেজিং
ডিরেক্টরকে সময় দিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট ভারতীয় হকি কি আজ
আটলান্টা থেকে হীরে নিয়ে আসবে আজ মনসার গান আজ মুজরিম হাজির
আজ এ মাউথফুল অব স্কাই আজ পঞ্চায়েত সমিতির ভোট আজ মাওয়ের
মৃত্যুবার্ষিকী হংকঙে কিংবা বেজিঙে অর্ধশত বেদনা রাখার অঙ্গীকার আজ
কোনও কোনও অঞ্চলে দু এক পশলা বৃষ্টি অথবা ব্জ্রবিদ্যুৎ বা বন্যাসহবৃষ্টি
হবেই আজ থেকে পর্যটনকর শেয়ার বিক্রির নতুন নিয়ম রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আজ
শিক্ষক অধ্যাপক সরকারী কর্মচারীদের বেতন আটকানোর প্রস্তাব আজ থেকে
বাংলাদেশী মোটর ব্যাটারি সংস্থা ভারতে বিক্রী করবে কলোনেল মোটর
পাটশিল্পে সংরক্ষন বজায় রাখার আজ আর্জি এন জ়ে এস সি কর্তার আজ
ভারতকে ১৩৫০ কোটি ডলার সরকারী ঋন দেবে আমার শ্বশুরকূলাজ
পানাগড়ের বাজারে ভীষন ক্রিয়াহীন কালিমূর্তির তাণ্ডব আজ শুটিং শুরু
হয়েছে সাধ আহ্লাদের আজ হ্রাদকানির সুবিশাল ভাক্লাভ হাভেলের ইন্ডিয়া
দর্শন আজ দেবোত্তর সম্পত্তি আইনের ৩৫ ধারা লঙ্ঘন করেছে স্বামী
নিশ্চলানন্দ সরস্বতী জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে অ্যানফ্রাক্স রোগের মহামারী
ঠেকানো সম্ভব হয়েছে বলে বনমন্ত্রী আজ দাবি করেছে আজ থেকেই তো
বাংলার বঙ্গীয় হাঙামা শুরু হয় আমার মাতৃকুল আজ অভিবাদন সম্পর্কে
নতুন আইনকানুন ঘোষনা করে আমি কী কাজ করি আজ অবশ্য সি বি
আই বা পিতৃকূল জানতে পারেনি আজ আমি আমার উদ্ভট নাটকের চরিত্র
বিশেষ আজ আমার বরাদ্দ একটা প্লেটে শক্ত  রুটি আর অদ্ভুত পাঁউরুটি আর

মুক্তিবাদ

যারা আমাকে ডিগডিগে
আমার রুহকে যুদ্ধের হিরো
আমার ঈশ্বরকে অনিষ্টজনক
আমার কবিতাকে
চাকচিক্যময় আভিজাত্য বা বিক্ষিপ্ত প্রলাপ মনে করে

আহ ভাইরে
তারা বাণিজ্যের অযথার্থ ক্ষমতা দিয়ে
তাদের নাক মুখ কান দখল করে
এই শক্তিশালী প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের
অস্তিত্ব রক্ষা করুক

যারা বালি ফুঁড়ে
আমাকে বাল্যপাঠ শেখাচ্ছে
আহ ভাইরে
তারা মেকি সুন্দরের মিথ্যে সীমারেখা প্রত্যাখ্যান করে
অন্তত্ব একটা ছোটখাটো দেবদূতের সন্ধান করুক

অকেজো জ্যুকবক্সে স্থির ডিস্ক
জীবনের আর ভাঙা ইঁটের
অশুভ যুদ্ধপরা যন্ত্রনায় আন্তর্জাতিক কোরাস
আহ ভাইরে

কবরখানা আর টাউনশিপের সুড়ঙ্গের মধ্যে গুঞ্জন করা
আস্তাবলের ধূর্ত পিটপিটে মায়া
মধ্যে মধ্যে ফ্যাঁকড়া
আহ ভাইরে

কাঁধে অগ্নিবর্ণের ক্যামেরা
হাতে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ট্রানজিস্টর
অন্য সম্রাটের দায় যাতে মেটে
মাংস ভেদ করে সচল ফ্রেস্কোর মত
এইসব রেডিয়ো-টিভি-অ্যাকটিভ যুবশক্তি
মুক্তিবাদ এবং জাঁকজমক খুঁড়ে নৈশস্তব্ধতা
আহ  ভাইরে

সাক্ষ্য

আমার অস্তিত্বের কেন একটা অজ্ঞাত উদ্দেশ্য আছে-আমি জানি না
আমার তুষারশুভ্র হাত আমাকে এগিয়ে দিয়ে
               নিজেকে ফুটকি রঙের সাহায্যে প্রকাশ করে
আমি থাকি তার যন্ত্রপাতির ও তার রত্নভরা শরীরের টূকরো টাকরার মাঝে
নির্দিষ্ট আমি, অদ্বিতীয় শান্ত, মানুষকে বোঝাই দর্শনীয়ভাবে উর্ধ্বে যেতে ও
নীলরঙের সন্ধ্যায় ছদ্মবেশে ঘুরি এক জাজ্জ্বল্যমান মূহূর্তকে প্রতিষ্ঠা
করার জন্যে আমার ঘৃষ্ট স্বরঃ আমি নগরের কোথা থেকে আসছি?
আমাকে কি ঈশ্বরের নিঃসঙ্গতার উপায়সমূহ উপহার দেওয়া যায়? আমার
শীতল স্থাপত্য কাঠামো সম্পর্কে কি কিছু করা উচিত? আমি মাথা নাড়ি
আমার মনঃসংযোগ অস্থিচূর্ণিত বামনমূর্তির
বেশে নয়। শিকারী পাখির বেশে।
আমি প্রতীক্ষা করি। আমি সর্বদাই আক্রমন থেকে আত্মরক্ষায় বিস্তৃত
সবুজ টুপির তলায় আমি মোহিনী দৃশ্য এনে বসাই
ভাঙা ভাঙা গোঙানি নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আমি স্বীকার করি-
আমি হচ্ছি সেই ধরনের মানুষ যে শুধুমাত্র আবর্জনা দিয়ে যায় না
আমি নদীর উজানে গিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিই।
আমি ঊষার অস্পষ্ট আলোতে নিজেকে বিশ্লেষন করি
আমি বিস্ময়কর সব আভরণ ছাড়িয়ে কাজে নামি
আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আলো আমি সৃষ্টি করি তা হারিয়ে যায় আমি
হিমঘাসে বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছি, সকলের সামনে কেঁচোর মত গুটিয়ে যাচ্ছি
বস্তুত শতাব্দীর মৃত আত্মারা উপুড় হয়ে ঝুঁকে পড়ে
হাড়ে হাড়ে ঠাণ্ডা অনুভব। উঁহু, ও হো
আমি বৃক্ষের সোনালী গুঁড়ি দিয়ে নিজেকে রূপান্তরিত করি।আমি
বাস্তবিক ভয়ংকর। গলা আমার আচ্ছাদিত গন্ধক ও ক্লোরিনের ওড়নায়
তবু আগুন যত্ বেড়ে ওঠে আমিও লুকোতে থাকি
আমি ব্যাখ্যেয় হেসে পথচলতি লোকের সামনে দুহাত তুলে ধরি
শেষে তাদের মিলিয়ে দিই গিঁট বেঁধে
শেষতম কলস্বর আমায় ঠেলতে থাকে।আমার প্রাচীন এই কোলাহলে
সৃষ্টির  পরিসরের জড়তা কেটে গিয়ে
                    অনুপস্থিত লোকেদের ছায়া এসে পড়বে
আমি সেই রং পবিত্র গন্ধ যার ভেতর টলে যায়
আমি সেই ক্ষুদে সূর্য, আমার দুটো ডাকের মধ্যে একটা কথা লা হয়ে যায়
আমি আমার পান্ডুবর্ণ কানাঘুষার কার্পেট পাতা রাস্তায়
                    আমার ভবিষ্যৎটাকে ফাটতে দেখেছি

সার্টিফিকেটের  পাঠ

আমার যে ভাই চায়না সার্টিনের একটা লম্বা আলখাল্লা পড়ত
এবং এক নির্দিষ্ট  জায়গায় আমাকে খুব জমকের সঙ্গে সম্বধর্না জানাত
সে আগুনে পুড়ে গিয়ে মারা গিয়েছে।

আর আমার যে বন্ধু  অস্ত্রোপচার বিদ্যায় ছিল অত্যন্ত কুশলী
এবং যে তরবারি ও তীরপূর্ণ তূনীর নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে
সূর্যকে নিয়ে আসার  চেষ্টা করেছিল
সে হাজতে পচে শেষে আত্মহত্যা করেছে
আমি বস্তুতঃ এখনও মারা যাইনি
এবং আমার মতলবের কথা ঘুণাক্ষরেও কারও কাছে প্রকাশ করিনি
কারণ এটা প্রকাশ করার মত কথা নয়।


ওদের দ্গদগে লালচে হাত
(থেমে) ওদের আমি ফুলগুলো দিতে চাইনি
অবোধ শিশুগুলি খেলায় মেতেছে
(থেমে) দুঃখের বিষয় ওরা আদেশ মানে না।
ওরা নগ্ন হয়ে যথেচ্ছ যৌনক্রিয়াকলাপ প্রদর্শন করছে
(থেমে) বিপ্লব থেকে মানুষের  মনকে ওরা দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবার  পক্ষে
ওদের সবচেয়ে কার্যকারী অস্ত্র
ওরা বাগানে মগ্ন গাছ  পুঁতে দিচ্ছে
(থেমে)  আমার বাগানের  গোলাপগাছগুলোর চোখে প্রবীণদের দৃষ্টি ।

প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না

ওখানে বাণিজ্য-জাহাজরা নোঙর ফেলে। দরিদ্র এক মানুষ ভগ্নস্তুপ দেখে
সর্বপ্রাচীন বাড়ি ধ্বংস হয়ে আসে। সুস্থ করে গাছের পাতা
অন্ধপ্রথাগুলি দাবি জানায়। মানুষজাতি পরিশ্রান্ত স্বপ্নচারী প্রাস্তর
বা জলরাশি অগ্নিময় হৃদয়ের পারে নেমে আসে। মেঘের শুকনো আনাগোনা
বিদ্যুতের সিরসিরানির সঙ্গে অন্তরীক্ষের শেষ খেলা দূরে সরে যায়
কৃষ্ণবর্ণ অরণ্যের অন্তরালে ঘ্রাণময় হ্রদে আমার হৃদয় স্বপ্নে মুগ্ধ হয়
জরা-মৃত্যুর পাশে ভিড় করা গাছের মধ্যে  উন্মুক্ত উদার সূর্যালোক এসে দাঁড়ায়
বৃক্ষের  প্রত্যঙ্গ নড়ে এবং মৃদু হয়ে ভাসে বিষন্নতা
আমার স্মৃতি নেই, আমি বিদ্বেষ কলহের অন্তঃসার বুকে নিয়ে বৃদ্ধ হয়ে আছি
আজ দেখি, অসংখ্য হিমাদ্রি-মৃত্যুভয়গুলি একদিন দুহাত দিয়ে বেঁধেছিল আমায়
আমায় ধরে থাকে অনন্ত সুচিরমৃত  শোভনপৃথিবী
আমার একাকীপাখি আমার  মধ্যে বিশ্রাম রাখে চিরকাল
মেঘে মাস্তুলে চিহ্নিত একটি সান্ধ্য আকাশ, জলে সূর্যাস্তের আভা
ত্রিশ কোটি অসহায় ছেলের কাছে বসে ক্ষমা চাই
হে জনচিহ্নহীন,দিশাহীন ছড়ানো-যৌগিক পরাজয়
স্বর্ণধরনীর মধ্যে সবুজের বৈষম্য হয়ে আসা দেখি
মধুর  জীবিত শীত নিয়ে যে-লোকটা গুঁড়ি মেরে আসছে
ও এখানে  দাঁড়িয়ে নেই
ওকে চিরমুক্ত  সৃজনব্রতে নামতে দাও
ভূগর্ভের পাথর খুঁড়ে-ও একবার তাপময় নির্জনতা গ্রাস করেছিল