Sunday, June 3, 2018

এবার নীরব করে দাও : শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়


ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি




     
                      এবার নীরব করে দাও


লেখা কী? এই প্রশ্নে বারবার নিজেকে আক্রমণ করে বিশেষ সুবিধে হয় না। বরং অনেক বেশি জড়িয়ে যাই না লেখায়। না লেখা কী? না লিখতে চাওয়া নাকি না পারা? দ্বিতীয়টাই বোধহয় সত্যি। হ্যাঁ এমন হয় যে ফরমায়েশি লেখা লিখতে অনেক সময় মাথা দেয় না। কিন্তু সে তো আমাদের নয়। মানে আমরা যারা ছোট কাগজের লেখক তাদের কাছে সেরকম ফরমায়েশ আসে কত? আবার যাঁরা খবরের কাগজ ভিত্তিক লেখেন তাঁদের একটা খ্যাতির মোহ আছে, আর্থিক লেনদেন আছে তাঁদের ক্ষেত্রে না লেখার কোনও অবকাশ নেই। মনে হয় এই দুইএর সংমিশ্রণে আমাদের ভাষায় রাইটার্স ব্লক হয় না! প্রতি বছরই দেখা যায় তাঁরা এক বা একাধিক উপন্যাস লিখেছেন সঙ্গে লিখেছেন ছোটদের লেখা, গল্প, পারলে ভ্রমণ সবই। বাংলাভাষায় কোনও গদ্যকারের কখনও লেখা থেমে গেছে বলে শোনা যায় না। তবে কবিতার ক্ষেত্রটাও কি এমন? বেশ খানিকটা তাই। সমালোচনার জন্য নয়, কিন্তু আজও আমাদের কবিতার একটা বড় অংশই স্বভাব বশত লেখা আত্মজৈবনিক। একান্তভাবে অনুভূতি নির্ভর। ফলত সেখানেও হয়ত এই থেমে যাওয়ার প্রশ্নটা নেই।  সারাজীবন এক কথা বলে গেলেও তাঁদের কোনও হেলদোল হয় না। তবে বেশিরভাগের বাইরেও একটা অংশ থেকে যান যাঁরা এই প্রবাহের মধ্যে পড়েন না বাংলাভাষায়।

কিন্তু আমি লেখা থামা বলতে সবসময় পূর্ণচ্ছেদ ভাবছি না। ভাবছি ভাবনার থেমে যাওয়াকে ভাবছি নিজেকে বদলানোর অন্ততঃ চেষ্টা না করাকে। দিনের পর দিন একইভাবে একই কথা বলে যাওয়াকে। আরও বুঝতে চেষ্টা করছি এই না ভাঙতে পারাকে। কোথায় লেখার উৎস সেটা বোধহয় কারুর জানা নেই। তবে এটুকু অনেকেই বুঝতে পারেন যৌবন শুরু করা স্বভাব কবিতা একসময় ছেড়ে যায়, তখন বোধহয় নির্মাণের দিকে ঝোঁকা উচিৎ। আবার অনেকে বলেন গোড়া থেকেই নির্মাণকুশলী হওয়া উচিত। আবার এরকম কবিও (?) পেয়েছি যিনি বিশ্বাস করেন কবি তার শ্রেষ্ঠ কবিতাটা ৩০ পেরনোর আগেই লিখে ফেলে। এর মধ্যে কিছু আরও কিছু ঘটনার উল্লেখ করি।

মুম্বাইতে কালাঘোড়া আর্টস ফেস্টিভ্যালে কথা  হচ্ছিল ভারতীয় ইংরেজি ভাষার কবিতার মহীরুহ আদিল জসসাওয়ালার সঙ্গে; তাঁর ২০১১ সালে বেরনো কবিতার বই ট্রায়িং টু সে গুডবাই পাঠকের কাছে বিরাটভাবে সমাদ্রিত হয়েছে, তরুণ কবিদের কাছে অভিভাবকীয় ছায়া হয়ে উঠেছেন তিনি। এর আগে ছিল এক দীর্ঘ নৈঃশব্দ্য। ১৯৭৬ সালে বেরিয়েছিল বেরিয়েছিল মিসিং পারসন, তার আগেও বেশ চুপচাপ প্রথম বই ১৯৬২ ল্যান্ড’স এন্ড। কেন এমন চুপচাপ? আদিল আমাকে বলেছিলেন বলার কিছু ছিল না তাই। ইংল্যান্ডবাস, সেখান থেকে ফেরা, কলেজে চাকরি করা, আইওয়া যাওয়া, ফিরে এসে খবরের কাগজে চাকরি। সাংবাদিকতা করে কবিতা লেখা মুশকিল। কবিতার ধারণা চলে যায়। আমার মনে পড়ছিল আদিল এর বন্ধু ও সেই একই প্রজন্মের আরেক কবির কথা, ডম মোরেস – তিনিও প্রায় ২০ বছর থেমে থাকার পর কবিতায় ফিরেছিলেন। ডম মোরেসকে চিনতাম না। কিন্তু তাঁর কাজের ও জীবনের সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত রঞ্জিত হসকোটেকে চিনি, তিনি মোরেসের মৃত্যুর পর তাঁর এক নির্বাচিত কবিতা সম্পাদনা করেছেন পেঙ্গুইন ক্লাসিক্স এ। কথা বলেছি বারবার রঞ্জিতের সঙ্গে। মোরেস নানা স্ববিরোধে মোড়া বাংলাবাজারে প্রচলিত কবির প্রোটোটাইপ (বহুগামী, মাতাল, দায়িত্বজ্ঞানহীন), যিনি সিগারেট কিনতে বেরিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ইসরায়েল চলে যান, তাঁর তৎকালীন স্ত্রীকে ছেড়ে। অস্থিরতাই কি তাঁর জীবন থেকে কবিতা চলে যাবার কারণ? মনে পড়ে আমার একদা-ঈশ্বর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কথা। আমি আজও শাক্ত তবে ধরতে পারি তাঁর ফাঁকি গুলো। মনে হয় কবিতা তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিল হেমন্তের অরণ্যের সময়ে। মাঝে মাঝে দেখা দিয়েছিল। যেমনটাবা মানুষ বড় কাঁদছেতে। কিন্তু সেই পূর্ণ কবিত্ব যে একসঙ্গে রাবীন্দ্রিক ও জীবননান্দীয় তার দেখা আমরা আর পাইনি ধারাবাহিকভাবে। এখানেও কারণ কি শৃঙ্খলাহীনতা? তাহলে তো চূড়ান্ত সুশৃঙ্খল কাউকে দেখতে পেতাম। মনে হয় শব্দ ও বাক্যের রসায়নটা কেউ বুঝে গেলে তাকে নিজের মত করে ব্যবহার করতে পারে, আর সে ব্যবহার থেকেই আসে একই রকম লেখা বছরের পর বছর লিখে যাবার খেলা। যেটা অনেক ক্ষেত্রেই কবির অজান্তে হয়। কোথায় যেন পড়ে ছিলাম ইয়েটস ডায়রিতে লিখে ছিলেন যে তিনি বুঝে গেছেন কবিতা কীকরে লিখতে হয় আর তার পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। শারীরিকভাবে কবিতা না লেখা, বা লেখা একটা বয়সের পর ছেড়ে দেওয়া বা দীর্ঘদিন পর কবিতায় ফিরে আসার থেকে বোধহয় বেশি বিপজ্জনক অসাড়ে এক লেখা নিয়ে গোটা জীবন কাটানো। এই ক্ষেত্রে কাজ করে নিজের তৈরি করা খ্যাতির বা পরিচিতির বৃত্ত না ভাঙতে চাওয়া, নিজের এক আরামক্ষেত্র থেকে বেরোতে না চাওয়া, বা স্রেফ বুঝতে না পারা যে তিনি নিজেকে পুনরাবৃত্তি করছেন। কিন্তু যাদের কবিতা লেখা সত্যি ছিল না দীর্ঘকাল তাঁরা সকলেই বলেছেন কবিতা  লেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। টের পাননি তাগিদটা। তবে এই সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রায় দীর্ঘ সময় পরে তাঁরা ফিরে এসেছেন কবিতায়। যেমনটা বা ডম মোরেস বা আদিল জসসাওয়ালা বা দূরের পল ভালেরি। তবে খুব কম জানা যায় তাঁদের সেই না লেখা পর্ব নিয়ে।

হেমিংওয়ে বলতেন যখন কাহিনি গতিময়, যখন লেখা আসছে তখন থেমে যাওয়া উচিত, পরে আবার বসে সেখান থেকে ভাবা তাতে নাকি লেখা থামে না। কিন্তু সেও তো আখ্যান বিশ্ব। কবিতার কি হয়? আমার নিজের এই ক্ষুদ্র কবিতাজীবনে প্রায় ৩ বছর কেটেছে কবিতাশূন্য। ২০১২ সালে শেষ হয়ে যাওয়া কাচের সর্বনামের পর আমি ২০১৪ সালের মে মাসে প্রথম কিছু লিখতে পারি। কিন্তু সে সময় বিচলিত হইনি। ক্রমাগত সাহেব সংসর্গ ও আর্যনীল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে থেকে যাওয়া আমাকে বিচলিত হতে দেয়নি। কারণ আমি সাধারণত কবিতা লিখি প্রকল্প হিসেবে।  আমার পরিচিত দেশগুলোতে দেখি প্রকল্প ধরে লেখার কথা বলা হয়। যেমন সিনেমার পরিচালক মেপে নেন তাঁর চিত্রপরিধি, তারপর চলার পথে হয়তো বা ইম্প্রোভাইজ – সেইভাবে।  আমিও সেখান থেকে শিখি। এতে দেখেছি উপকার হয়।



এরপর আসে কবির সামাজিক নীরবতার কথা, বা ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে কবির সামাজিক সরবতার কথা। কবি কখন সামাজিক অর্থে নীরব বা সরব সেটা ইতিহাস বলে সময় নির্ভর। যদিও কবিতা কখনওই জনসমক্ষের পারফর্মিং আর্ট নয় বলে অনেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন (যেমনটাবা এরিক হবসবম)। কিন্তু বিশ শতকে দেখা গিয়েছিল কবিকে এক সামাজিক প্রবক্তা হিসেবে। যদিও এখন সময়টা ২১ শতক, আর রাজনীতি পরিপূর্ণভাবে টাকার খেলা। এসময় কি কবি আর দলের হয়ে কাজ করবেন? ইউরোপ তো উন্নত এলাকা, সেখানে বিদ্বজন দলদাস নন, তা দেখা গেছে।  তাহলে আমাদের মত দেশে কী হয়? আমি এস্পানিওলভাষী আমেরিকায় দেখি ইউরোপেরই প্রতিধ্বনি। কলোম্বিয়ার মেদেয়িন কবিতা উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা কবি ফেরনান্দো রেন্দোন ও তাঁর দল কাজ করে চলেছেন ড্রাগ ব্যাপারী গেরিলা যোদ্ধাদের সঙ্গে সরকারের শান্তি প্রক্রিয়ায় কাজ করতে। সেখানে কবির কাজ সামাজিক। কিন্তু রাজনৈতিক দলের নয়। ঘোষিত বামপন্থী কবিরাও দলের নন। তার বিনিময়ে তাঁদের অনেক সময়ই শাস্তির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু কাজ চলে। আমাদের এখানে নন্দীগ্রাম চলাকালীন যে উৎসাহ দেখা গিয়েছিল বিদ্বজনের মধ্যে, তা খানিকটা আশার কথাই। কিন্তু আমাদের ভূমিকা বদলে গেছে। আমাদের এই ঘনবসতির দেশে সামাজিক পরিচিত একটা বড় ভূমিকা আছে। যেখানে পশ্চিমের দেশে বাচ্চারা শেখে অনেকের মধ্য একজন হতে, আমাদের শেখানো হয় অনন্য হতে। আলাদা হতে। হয়ত সেটাই আমাদের সামাজিক কম্প্রোমাইজের বীজ। নিটশে কথিত ক্ষমতার লোভ আমাদের নীরবতার কারণ হয়ে যায় হয়ত। আমাদের আরও বেশি সামাজিক করে তোলে। সমাজগ্রাহ্য করে তোলে।  কবিতা লেখা ও তার মারফত কেউকেটা হতে চাওয়া  হয়ে ওঠে আমাদের সামজিক পরিচয়। কেউ না পড়ুক কবিতা টিভিতে মুখ দেখিয়ে (এমনকি রান্নার রিয়ালিটি শোয়ে) কবি পরিচিতি লাভ করা যায়। আর এই সবকিছুর পিছনে প্রচ্ছন্ন বা প্রকট থাকে শাসকদল। যখন যে ক্ষমতায়।

এই ক্ষমতা ও অক্ষমতার টানাপোড়েনে কবিতা অন্য পথে যেতে চাইল কিনা, কবিতাও ভাবনার মাধ্যম তা ভুলে যাই আমরা। লিখে যেতে থাকি পরপর দাবীপত্র। লিখে যেতে থাকি নিজেদের পুনরাবৃত্তি। হয়তবা কবিতা-লিখিয়ে হয়ে উঠি আমরা।

তবে এখনও উত্তর পাইনি অনেক কবির জীবন থেকে কবিতার প্রয়োজন কেন ফুরিয়ে যায়!




No comments:

Post a Comment