Sunday, June 3, 2018

মুখর নীরবতা : উৎপল চক্রবর্তী

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি





                                                            মুখর নীরবতা





নীরবতার কবি' আর 'কবির নীরবতা' এই দুই শব্দবন্ধের মধ্যে কবি শব্দটি প্রথমেই ভাবাতে শুরু করে। প্রশ্ন ওঠে কবিতা কী ও কবিও বা কে?  ঠিক কতগুলো কবিতা লিখলে কবি হওয়া যায়? কবি কি ছন্দে লেখেন কথা? নাকি গদ্যে লেখেন দর্শন? কবিকে কি পুরস্কারপ্রাপ্ত হতেই হবে?
কবিতা কি একটি অনুচ্ছেদের মতো দেখতে? নাকি কবিতা বলতেই স্তবক?কাপলেট?
যে বিজ্ঞানী ল্যাবরেটরিতে বসে স্বপ্ন দেখেন নতুন নতুন তিনিও কি কবি নন? এ প্রশ্ন তো আজকের নয়। 
তাই উত্তর দেওয়ার বৃথা চেষ্টা থেকে বিরত থেকে ধরে নিতে হবে কিছু একটা। ধরে নিলাম যুগ যুগ ধরে কবিতা লিখে যাঁরা কাব্য জগতের পথিকৃত হয়ে আছেন, যাঁরা কবি হিসাবে বর্তমানে বহু পরিচিত ও যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক সাম্প্রতিক  ঘটনা নিয়ে কলম ধরেন আবার নীরবও থাকেন তাঁদের কথাই এখানে বলা হচ্ছে।
তবুও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্ন ওঠে কবির নীরবতার কারণ ও ফলশ্রুতি নিয়ে।
যদি ধরি কবির নীরবতা  চারিত্রিক অদৃঢ়তার অশনিসংকেত, যদি ধরি কবির নীরবতা এক  এস্কেপিজম, রূঢ় বাস্তব থেকে পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছা, যদি ধরি কবির নীরবতা এক  অপারচুনিজম বা অত্যাচারী শাসকের ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার অন্য নাম, তাহলে সেই নীরব কবিরা নি:সন্দেহে ভিন্ন মেরুর অভিযাত্রী। এখানে তৈরি হলো বিভাজন। প্রকৃত কাব্যরস থেকে  সমঝদার পাঠকের বঞ্চনা। অন্যদিকে 'নীরবতার কবিরা' বা নিভৃতিকে ভালোবাসেন যে কবিরা তাঁরা থেকে গেলেন নির্বিকল্প সৃষ্টির স্বর্গোদ্যানে। সহস্রধারার সতত প্রবাহে চঞ্চল। মগ্ন। আর নীরব কবিরা? তাঁরা দিন গুনতে থাকলেন। সময়ের স্রোতে বিলীন হওয়ার অপেক্ষায় । শুরু হলো 'কবির নীরবতা' আর 'নীরবতার কবি' এই দুই শব্দবন্ধের অর্থগত সমান্তরাল ও ভয়ংকর চলন।
কিন্তু  যদি ধরি কবির নীরবতা
এক মৌন প্রতিবাদ কিংবা ঘন ঘন ব্যর্থ প্রতিবাদ- উত্তর উদাসীনতা তাহলে তিনি তো নিজেই সময়, সৃষ্টিবীজ। নীলকণ্ঠ।
'কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশি সংগীত হারা, অমাবস্যার কারা লুপ্ত করেছে আমার ভুবন'।
মৌনতা এখানে মুখরতা। অসহযোগ বিপ্লব।
এখানে আবার 'কবির নীরবতা' ও 'নীরবতার কবি'  কোনও এক ছেদ বিন্দুতে বিলীন।
তখন কবি যেমন হিমালয়ের মতো মৌন মুখর, তেমনি আবার অবিশ্রান্ত ঝর্ণাধারার মতো সশব্দ।

যেভাবে নিঃশব্দে সন্ধ্যা নামে, সকাল হয়, শিশির পড়ে ঘাসের ওপর, যেভাবে অনন্ত রাত চেয়ে থাকে শুধু, কোনও কথা বলে না, সেভাবে কবি ঋষিরা নীরবতা খুঁজেছেন যুগ যুগ ধরে। নীরবতার কবিরা নিভৃতের উপাসক, নির্জনতাপ্রেমী। তাঁরা চিরকালই নীরব থাকতে চান। সুখে দুখে উদাসীন। কখনওবা তাঁরা উইয়ের ঢিপির মধ্যে নিবিড়:
'আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়'।
কখনও তাঁদের করুণ ও আন্তরিক প্রার্থনা : 
'এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে'। 
ওয়ার্ডসওয়ার্থের  মতো তাঁরা
প্রকৃতির সেই নির্জনতার আনন্দ স্নাতক হতে চান: 
'That on a wild secluded scene impress 

Thoughts of more deep seclusion; and connect 

The landscape with the quiet of the sky. '
আধুনিক কাব্য সমুদ্রের টাইটানিক শঙ্খ  ঘোষের মতো ভাবতে শুরু করেন:
'এত বেশি কথা বলো কেন?চুপ করো শব্দহীন হও.....আয়ু লেখো'।
টেনিসনের মতো ভাবেন শব্দের অসহয়তা :
Words are the inadequate vechiles of thought.
জয় গোস্বামীর মতো অনুভব করেন শব্দ এক ফাতনা মাত্র। তা দিয়ে  মাপা যায় মাছরূপ প্রক্ষোভটি কতটা সঞ্চারী তার আপাত গভীরতা। তাছাড়া শব্দের আর কোনও মূল্য নেই। ঠিকই  নীরবতাই শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ভাবনা প্রকাশের।
ওয়াল্টার ডি লা মেয়ারের মতো তাই যতই আমরা বন্ধ দরজায় আঘাত করি না কেন, আমাদের কথাগুলো পাথরে পাথরে ঠোকা লেগে শুধু ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে নিজের কাছে। আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর হয়ে ওঠে প্রশ্ন। নীরবতা। তাই বলে কি কবি নীরব থাকবেন নির্গুণ ব্রক্ষ্মের মতোই? তাহলে কত জন বুঝবেন এই মানব জীবনের মাহাত্ম্য ? কি ভাবে হবে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিবাদ, প্রদীপ জ্বালা? তাই নীরব সাধনার আকর হয়েও পৌত্তলিক হয়ে উঠতে হয় কবিকে মাঝে মাঝে। না হলে 
কে ভাসাবে তরি যমুনার ওই নীল জলে? কে বলবে তুমি ওদের ক্ষমা কোরো? কে লিখবে  কলসীর কানায় চুম্বনের ক্ষত?
কে জ্বালাবে আলো তরুণ তুর্কির  মনে? কে বলবে?
'কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট..' 
কিংবা
'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে'।
ধর্মীয় সংস্কারের ভুল দিক কে দেখিয়ে দেবে চোখে আঙুল দিয়ে? কে বলবে?
'রথ ভাবে আমি দেব পথ ভাবে আমি।
মূর্তি ভাবে আমি দেব হাসেন অন্তর্যামী '?
প্রসাধনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে কে লিখবে: 'একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি তোমার জন্যে গলির কোণে ভাবি আমার মুখ দেখাব মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'?

No comments:

Post a Comment