Sunday, June 3, 2018

ধ্বংসস্তূপের নীরবতা কি কোনও কবিরই কাম্য? : হিন্দোল ভট্টাচার্য


ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি









   ধ্বংসস্তূপের নীরবতা কি কোনও কবিরই কাম্য?



‘কবি’ একটি খুব রহস্যজনক অস্তিত্ব। ভীষণ আপেক্ষিক একটি শব্দও বটে। কারণ যিনি ‘কবি’, প্রকৃতই কবি, তিনি নিজেও জানেন না হয়তো, কখন কবিতা এসে তাঁকে স্পর্শ করে চলে যায়, কখন তিনি তাকে অনুবাদ করতে সক্ষম হন, আবার কখন কবিতা তাঁকে ছেড়ে চলেও যায়। অপ্রত্যাশিতের খোঁজে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয় সেই শিকারী শ্বাপদের মতো। আর নিজের মধ্যে গ্রহণ করতে হয় সমসময়, ফেলে আসা সময় এবং যে সময় ভবিষ্যতের, তার সমস্ত বিমূর্ত যন্ত্রণাগুলিকে, আনন্দগুলিকেও। সময়ের সুচিন্তিত বোধের কাছে নিজেকে এক গ্রাহকের মতো নীরবতায় প্রস্তুত করে রাখাটাই হয়তো তাঁর সাধনার এক অংশ।

স্বভাববশতই, তিনি একই সাথে যেমন দ্রষ্টা, তেমনভাবেই দৃশ্যের অংশ-ও বটে। যেমন প্রেমিক, সহ্যাতীত যন্ত্রণার শরিক, আনন্দের ছন্দ, বিপন্নতার সংকেত, তেমন তিনি নিজেই যন্ত্রণা, নিজেই সংকেত, নিজেই আনন্দ ও নিজেই প্রেম। হেমন্ত বা বসন্ত যখন আসে, তখন তারা তো শুধু বাইরে থেকে আসে না, ভিতর থেকেও আসে। ধরা যাক, আমি হেমন্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছি। হেমন্ত এসেছে। ঝরা পাতার মতো উদাসীনতায় ঝরে পড়ে যাচ্ছে সময়। তখন আমি কি নিজেও হেমন্ত নই? কেবল কি হেমন্ত এসে আমাকে হেমন্ত করে দিচ্ছে? আমি কি নিজেও হেমন্ত হওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছি না? পূর্ণ যেমন আমার দিকে এগিয়ে আসছে, তেমন আমিও পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলেছি। অথচ জীবন মানেই তো খণ্ডবৈচিত্রের খেলা।
স্বভাববশতই , সে , তাই বিপ্লবীও বটে। প্রশ্নটা হল কেন বিপ্লবী? সে কি কোনওকিছু পালটে দেওয়ার দায় নিয়ে এসেছে? কিন্তু সে কি চায় না সব কিছু পালটে যাক? যদিও এই সব কিছু পালটে যাওয়ার পিছনে ভূমিকা তার অল্পই, তবু সে চায় পালটে যাক সবকিছুই, যেভাবে যা চলছে, তা ঠিক চলছে না। কিন্তু সে তো এক পাগলের মতো। সে তো হাজারগণ্ডা ভেবে, কোন কথাটি বললে কী ফল হতে পারে, চিন্তা ক’রে, তবে কোনোকিছু করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে না। তার পক্ষে পলিটিকালি কারেক্ট হয়ে তার পর  জীবনে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া ধাতে যদি থাকত, তাহলে সে আর কবি বা শিল্পী হতো না। কারণ মেপে তো চলে সারা জগতের মানুষ। কবিকেও যে মাঝে মাঝে মেপে চলতে হয় না, তা নয়। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই সে মেপে চলতে গিয়ে ভুল করে  ফেলে। কারণ সে যত জ্ঞানী হোন, যত পাগল হোন, যত ক্ষ্যাপা হোন, যতই বা প্রেমিক হোন, তিনি আসলে বেহিসেবী, ঠিক কেরিয়ারিস্ট হতে, রাজনীতি করতে তিনি আসেননি, জানেনও না।
তাই বলে তিনি কি রাজনীতি থেকে দূরে? কখনোই নয়। তিনি মূর্খ। তিনি সামাজিক নন। কিন্তু সমাজ থেকে তো দূরেও নন। রাজনীতি থেকেও দূরে নন। বাজারে গিয়ে ওষুধটি কিনতে হয় তাকে। তার বাড়ির লোক এই দেশেই বিভিন্ন রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরে বা কলেজে স্কুলে অফিসে যায়। পেট্রোল ডিজেলের দাম বাড়লে, ওষুধের দাম বাড়লে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়লে তাঁর গায়েও এসে লাগে প্রত্যক্ষভাবেই। এমন তো নয়, তিনি কবিতা লেখেন বলে টাকা পয়সা থেকে শতহস্তে দূরে থাকেন। আর সেভাবে কবিতাটিও হয় না। কারণ জীবন থেকে দূরে থাকলে কবিতা কোথা থেকে আসবে তার কাছে? কবিতার জন্য যেমন সত্য ফুল পাখি ঘাসের শব্দ, তেমন-ই গুরুত্বপূর্ণ জীবনের কাটা-ছেঁড়া-জোড়ার গল্পগুলো। এই বাস্তবতার জমিতেই তাঁকে জীবন কাটাতে হয়। একটু পা চালিয়ে যেতেও হয়। আবার কাফকার মতো নিজেকে অনুভব করতে হয় এক পোকার মতো। কখনও বা এলিয়টের মতো অনুভব করতে হয় খড় বোঝাই মাথা নিয়ে আমরা সবাই এক একটি শূন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। রাজনীতি মানে শুধু তো ক্ষমতাদখল বা ক্ষমতাবদলের যুদ্ধ নয়। রাজনীতি মানে নয় শুধু পুরভোট, বিধানসভা, লোকসভা , নির্বাচন বা যা চলে সারাবছর খবরকাগজের প্রথম দ্বিতীয় পাতাগুলোয় বা সারা সন্ধে চ্যানেলগুলোয়। এগুলো রাজনীতির বাইরের রূপ। কবি বরং অনেক বেশি জ্ঞাত রাজনীতির ভিতরের রূপ সম্পর্কে। তিনি ইতিহাসের প্রেক্ষিত থেকে রাজনীতিকে, ক্ষমতাকে দেখেন। তিনি বুঝতে পারেন –আমাদের সোনা রূপো নেই তবু আমরা কে কার ক্রীতদাস? তিনি ভাষিত-এর মতো কবিতা লেখেন। ‘নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয় লিবিয়ার জঙ্গলের মতো’। যেমন জীবনানন্দ আকাশের ওপারে আকাশ দেখেছেন, তেমন দেখেছেন কীভাবে এ শহরের বাতাস চিনাবাদামের মতো বিশুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। এই বিশুষ্কতা সময়ের বিশুষ্কতা। নাহলে একজন তাঁর সমসাময়িক কবিও কেনই বা লিখবেন এপ্রিলকে নিষ্ঠুরতম মাস হিসেবে? এই দেখার যে ‘ভিশন’ তা-ই বৃহত্তম রাজনীতি। পাররা যেমন শূন্যতাকে দেখেছিলেন নিজের পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়া শূন্য কফিনের মতো। লোরকার কবিতায় যেমন পাওয়া যায় এক নিষ্ঠুর স্বৈরতান্ত্রিক সময়কে।
কোনও কবি কি বলতে পারেন তিনি সমসময়কে বাদ দিয়ে চিরকালীন এক মহাকাশযাত্রাকেই অবলম্বন করে রচনা করছেন তাঁর দার্শনিক অভিযাত্রাগুলিকে?  সমসময়ের ছোট ছোট অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যেই তো থাকে চিরকালীন বোধগুলি। সমকালীন সময়ের সংক্ষোভগুলিকে তিনি কি আদৌ এড়িয়ে যেতে পারেন? পারেন না। অনুভূতিমালার সূক্ষ্মতম অংশে যাওয়া যেমন তাঁর কবিজীবনের অংশ, তেমন সমাজজীবনের এই সূক্ষ্ম রাজনীতিকে অনুধাবন করাও তাঁর কবিজীবন বলা  যায়। মানুষের হাসির ভিতরে লুকিয়ে থাকা বিষাদ এবং বিষাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা হাসির অন্তরালে যে ক্ষমতার সঙ্গে অদৃশ্য অসম দ্বৈরথ চলতে থাকে, তাকে তিনি তো পড়বেন।
প্রকৃতির নীরবতা বা জীবনের নীরবতা, যা বাঙ্ময় ভীষণ, যা মাঝে মাঝে আসে, আর বোধের ইশারাকে ছুঁইয়ে দিয়ে যায়, তাকে ধারণ করার জন্য এক অন্তরের স্তব্ধতার প্রয়োজন হয় বলে আমার ধারণা। গাছের পাতাগুলিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় কত নীরব, কিন্তু অন্তরালে তার রান্না চলতে থাকে। সে কিন্তু বাইরে যতটা স্থির, ভিতরে ততটাই চঞ্চল। কিন্তু এই চঞ্চলতা আসলে স্থিতপ্রজ্ঞ চঞ্চলতা। একজন কবির চঞ্চলতা মনে হয়, এই পৃথিবীর শান্ত অস্থিরতার মতো। এই শান্ত অস্থিরতা না থাকলে কোনও অরূপ, রূপ পাবে না, পেতে পারে না। এই যে চারিদিকে আমরা দেখি গভীর নীরবতার পৃথিবী, তা কিন্তু আদৌ নীরব নয়। কত শব্দ চারিদিকে! গাছ থেকে পাতা খসে পড়ার শব্দ, মানুষের হেঁটে যাওয়ার শব্দ, দূরে হয়তো কোথাও কেউ তার মাকে ডাকছে, তার মাকে ডাকার শব্দ, মেঘ ডাকছে, বারান্দায় হালকা রোদ পড়েছে, পাখিরা ডাকছে। দূরে স্লোগান দিতে দিতে চলে যাচ্ছে কোনও মিছিল। বড় রাস্তায় গাড়ি যাচ্ছে। কোনও বাড়িতে সিরিয়াল চলছে হয়ত। এই দেখলে, আমি কেমন কথা বলতে বলতে শব্দ শুনতে শুনতে শহরে চলে এলাম। কেমন মফস্বল ঘনিয়ে এল আমার চারিদিকে। আমি কিন্তু কিছুই এগুলির মধ্যে তৈরি করিনি। এগুলি আমার চারিপাশে তৈরি হয়েছে মাত্র। এ সব কিছুর শব্দ আছে। কান পাতলে আর নিজেকে একটু নির্জনতায় রাখলেই শোনা যায়। কিন্তু সেই নির্জনতায় আসার জন্য নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে, তার কোনও মানে নেই। বরং ভিড়ের মধ্যে অনেক বেশি নির্জন হওয়া যায়। ভিড় এক নির্জনতা, গভীর নির্জনতা। কারণ ভিড়ের সব আছে, মুখ নেই। ঠিক যেমন রাজনীতি। রাজনীতির মধ্যেও একা হয়ে ওঠা যায়। যদি নিজেকে এক ক্যামেরার মতো করে তোলা যায়। কিন্তু ক্যামেরা কি কোনও শ্রেণিচরিত্র নেই নাকি? ক্যামেরা কি এক নির্বোধ নীরোর মতো, যার শহর পুড়ে গেলেও সে বেহালা বাজায়? আমরা কি ভুলে যাব রবীন্দ্রনাথ, লোরকা, স্পেন্ডার- এদের কথা? ভুলে যাব স্বয়ং বোদল্যের বন্দুক হাতে দৌড়েছিলেন? ভুলে যাব, যখন ঘরে কেউ আগুন লাগায়, তখন মহাবিশ্ব মহাকালের কথা বলে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা এক মধ্যবিত্ত বিলাসিতা মাত্র?
বিলাসিতা বললাম? হ্যাঁ বিলাসিতাই বললাম। যদি তোমার পাড়ায়, তোমার শহরে সব গলির মুখ বন্ধ করে কোনও মুখ্যমন্ত্রী সেখানে উন্মত্ত হিন্দু ফ্যাসিস্ট ঢুকিয়ে দিয়ে বলত নিধন করো মুসলিমদের, তাহলে তো তুমি পার পেতে না ভাই। যদি চুপ করে থাকি, কাব্য করি কী ঘটেছে কার দোষে বলে, তাহলে ‘ আমার সমস্ত শিল্প আজ থেকে গণহত্যাকারী’ হয়ে যাবে না কি? কবিতা বা শিল্পের নান্দনিক সত্যকে ধরার জন্য অন্তরের যে নীরবতা প্রয়োজন হয়, তা যেমন  আত্মশক্তি, তেমন কিছু কিছু সময়ে কবির নীরবতা হয়ে ওঠে শোষকের হাতিয়ার। তাই একজন কবির এসব বিষয়ে অংশগ্রহণ করা কাজ নয়, সে শুধু প্রেমের কবিতা লিখবে বলে এসেছে, এসব কথা যারা ভাবে বা বলে, তারা সম্ভবত পৃথিবীর ইতিহাসে কবিদের ভূমিকার কথা ভুলে যায়।
নীরবতার কবি যিনি, তিনি নীরব নন, স্থিতপ্রজ্ঞ। গাছের পাতার মতো। তাঁরও নির্দিষ্ট একটি মতাদর্শ আছে। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট মতাদর্শকেও তিনি আক্রমণ করতে পারেন, যদি সেই মতাদর্শ সভ্যতার পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়। কীসের ভয় কবি? প্রাণের ভয়? হারাবার ভয়? হারিয়ে ফেলার ভয়? না কি না পাওয়ার ভয়? আজ সে যে কোনও শাসক যদি তরুণ বা না-অতি তরুণ বা যুবক বা প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ কবিকে ভয় দেখায়, যে তিনি পাবেন না উপযুক্ত স্বীকৃতি, পাবেন না ন্যূনতম সহায়তা, তাঁকে একঘরে করে রাখা হবে, - এই সব কি ফ্যাসিস্টদের চরিত্রের অঙ্গ নয়? তখন কি পালটা প্রশ্ন করা উচিত নয়, যে তুমি বা তোমরা যা করছ, তাকে আমি রাজনীতিই বলে মানি না। কারণ একজন কবিকে কোনও ক্ষমতাকাঠামোর বৃত্তে বেঁধে ফেলা যায় না। তিনি থাকেন শাসকের সমীকরণের বাইরে। তাঁর কাব্যিক পারসোনাই তাঁকে বিদ্রোহী করে তোলে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ক্ষমতাবৃত্তে যাওয়ার বিদ্রোহ নয়, বরং না যাওয়ার বিদ্রোহ।



5 comments:

  1. ভালো লাগল প্রবন্ধটি। বাসবিক রূপরেখায় সত্য দর্শন করানোর জন্য ধন্যবাদ কবি

    ReplyDelete
  2. ভিড়ের মাঝে নীরব থাকা, নীরবতা স্থিতপ্রজ্ঞার আরেকরূপ - সময়ের জন্য বড়ো সত্যভাষণ। কবিতাতো আসলে সৎ এবং সত্যির জায়মান ভাস।
    সুন্দর, স্তরায়িত উন্মোচন !!

    ReplyDelete
  3. Tonmoy ChattopadhyayJune 7, 2018 at 4:29 AM

    কবিত্ব আর বাস্তবতার এক অপূর্ব মেলবন্ধন। কবি মানে পি পু ফি শু নয়। বরং সমস্ত আঁচে নিজেকে সেঁকে বাকিদের সাবধান করা এই আগুন থেকে। শিখতে পারলাম অনেক কিছু এই লেখা পড়ে।

    ReplyDelete
  4. ভালো লেখা ।

    ReplyDelete
  5. গত কয়েক বছরে কবিতা নিয়ে,কবির দেখা ও অবস্থান নিয়ে, কোলাহলের মধ্যেই কী ভাবে বাঙ্ময় নীরবতার ভাষ্য সৃষ্টি হয়,এসব নিয়ে এত ভালো লেখা আমি পড়িনি। অশেষ ধন্যবাদ হিন্দোল!

    ReplyDelete