Saturday, June 2, 2018

অণুগল্প- মহেশ্বর মাজি




কবি


অনেক পুরনো এই আটচালাটা।জিয়াউল রহমানের ঠাকুর্দা লাল কাকরের মাটি মেখে,মেখে অনেক কষ্ট করে তৈরি করেছিলেন।
রহমান চাচা তখন ছোট ছিলেন।তবে আজো দেওয়ালের গা থেকে ঘামের গন্ধ পান।
পাড়াতে কিছু হিন্দু মানুষও বসবাস করেন।রহমান চাচা সবার মনে বসবাস করেন।
গাঁয়ে ঢুকতেই বাঁ দিকে জীর্ণ একটা ছোট শিব মন্দির পড়ে।দরজাগুলো অনেকদিন আগেই কিছু মানুষের উদরপুর্তিতে লেগে গেছে।
বড্ড নোংরা হয়ে থাকে চাতালখানা।গরু,ছাগলের মল,মূত্র ছাড়া মদের বোতল,গ্লাসও পড়ে থাকে।
আগে নারুনী বুড়ি সকালে ধূলো উড়িয়ে পরিস্কার করে যেতেন।
বুড়িটা গঙ্গালাভের পর আর কেউ পূজো দিতেও আসে না।
ঘরে,ঘরেই শিবরাত্রি করে।
রহমান চাচা রোজ এখন জল,টল ঢেলে পরিস্কার রাখেন।
পাশ থেকে সাঈদূল সাইকেল থেকে নেমে বলে উঠল,চাচা দেওয়ালটা এ বছর ইলেকশনে আমাদের দিতে হবে।
রহমান চাচা আর এক বালতি জল নলকূপ থেকে ভরতে শুরু করলেন।আমল দিলেন না।
প্রতি বার এই সময়টাই তাকে অনেক জনের দাড়ি,দুড়ি দেখতে হয়।
তর্ক তার ভাল লাগে না।
মেয়ে আমিনা এবছর উচ্চ মাধ্যমিক দিল।মাঝে,মাঝে ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে।
    ভেঙে দাও না আব্বু।পার্টির লোক বলেছে তো পাঁকা বানিয়ে দেবে।
রহমান চাচা চুপচাপ থাকেন।হৃদয়টা নিঃশব্দে মড় মড় করে ভেঙে যায়।তখন আর তাকে আর কেউ জিজ্ঞাসা করতে আসবে না। অধিকার চাইবে।
বয়স হচ্ছে। হাড়গুলো কী আগের মত শক্ত আছে?
দু বালতি জল বয়তেই হাঁপ ধরে যায়।
আজানের শব্দ ভাসছে। এক পাল পায়রা টালির চাল থেকে ফড় ফড় করে উড়ে গেল।
সাঈদুল সাইকেলে উঠে বসল।
     নমাজের সময় হল।সন্ধ্যেয় দেখা করব।
রহমান চাচা মনে মনেই অল্প হাসলেন।
     বেগুন খেতে জল ধরাতে হবে।গাছগুলো শুকিয়ে আসছে।ভোলার সাথেই ভাগাভাগি করে মাথনা করে পুকুরের জল তোলেন।অনেকদিনের অভ্যেস।না হলে কব্জির জোর কোথায়?
তালে,তালে টান দিলেই হয়।ভোলা সামলে নেয়।
 
        চাচা,তোমার মেয়ে আমিনাকে দেখছিলাম মোড়ের মাঠে আলমের সাথে গল্প করছিল।জামাই করছ নাকি?
কথাটা শোনার পর থেকে তালে গন্ডগোল শুরু হল।অর্ধের বেগুন গাছগুলো শুকনোই রেখে বাড়ি ফিরলেন।
রহমান চাচা রেগে গেলে,বিছানায় শুয়ে পড়েন।
আমিনা নুপূরের শব্দ তুলে ঘরে ঢুকল।
    আমি তোমার রফিকের হাত কোনদিনও ধরতে পারব না। তুমি কথা দিয়েছ,তুমি জানো।আমি আলমকে ছাড়া কাউকে শাদি করব না।কী আছে ওই রফিক কবির?...কবিতা লিখলেই পেটটা ভরবে বুঝি?এতদূর পড়েও তো সেই বেকার বসে রয়েছে।তোমার সাথে বেগুন চারা লাগিয়ে আলমের মত বাইকে করে ঘোরাতে পারবে?...ওই বেকারছোদার গলায় ঝোলার থেকে গাছের ডালে ঝোলা অনেক ভাল।
সকালে রহমান চাচা মন্দির ধুতে গিয়ে শুনল।ভেতরে একটা ভয়ানক সাপ ঢুকে আছে।
রহমান চাচা নলকূপে বালতি বসিয়ে রাগে কবার হ্যাচকা মারলেন।
    ঢুকবেই তো।সময় হয়েছে।বুকে হেঁটে নয়।একেবারে পায়ে হেঁটে ঢুকবে।সকলের ঘরে,ঘরে।সাবধানে থাকবি।
লোকে সেইজন্য ছোট করে তাকে "পাগল" বলে।তার সাথে আর একজন শিক্ষিত পাগল জুটে গাঁ টাকে বদনাম করে রেখেছে।
রহমান চাচা ভেতরে আজ কটা বেলুনের মত নোংরা লাগা জিনিস কুড়িয়ে পেলেন।হাত দিয়ে উঠাতে খারাপ লাগছিল।তিনি কর্তব্য ভেবে পরিস্কার করলেন।
প্রথমটাই সকলে ভেবেছিলেন,হয়ত সাপের খোলস হবে।
তারপর সবাই ভয় পেয়ে বলে উঠলেন,শিব জেগে গেছে।মন্দিরের ভেতরে নোংরা কাজ হচ্ছে।
এখন শিবতলায় আর রহমান চাচা যান না। হিন্দুর ছেলে,মেয়েরা দুধ,জল ঢালে।
ভোর,ভোর ঘন্টার আওয়াজ পেয়ে ওঠে পড়েন।
নমাজের জন্য তৈরি হতে হয়।শরীরটাও বইছে না।
আমিনার ঘর ছাড়া দুমাস হয়ে গেছে।রফিককে আসতে মানা করলেও শোনে না। তিনবেলা তার হাল,হকিগত নিয়ে যায়।নাড়ি দেখতে জানে।অল্প কবিরাজি বিদ্যে আছে।ওই সব লতা,পাতা নিঙড়ে মধুর সাথে মিশিয়ে খাইয়ে যায়।না হলে কবেই তিনি কবরে জায়গা দখল করে শুয়ে পড়তেন।
এখনো তিনি চোখ বুঁজলে নাজিমার চুড়ির শব্দ রিনিরিনি শুনতে পান।
হঠাৎ করে যে কী হল।আল্লার ডাক এসে পড়ল।দুদিনের জ্বরেই চলে গেল।
ঘরটা তো তখন থেকেই শূন্য পড়ে আছে। আজ হৃদয়টাও ফাঁকা।
ঘুঘু ডাকে।বড় কষ্ট হয়।তিনি আর দ্বিতীয় শাদি করেননি।নাজিমার চুড়ির শব্দকে একমাত্র সম্বল করে এতটা পথ পার করে আজ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন।
তাও যদি মেয়েটা রফিকের সাথে ঘর বাঁধত।বুকের ঘাঁগুলো এত তাজা হত না।
দরজার আওয়াজ পেয়ে ভাবলেন রফিক এল বোধ হয়।
সাঈদুল একটা মেড়া টেনে বসল।
   সেলান আলিকুম চাচা। বলি, শরীর ভাল তো?
রহমান চাচা কথা বলেন না।
সাঈদুল মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলে উঠল,তুমি যদি একবার বল না চাচা রফিক শুনবে।বিরোধীদের নিয়ে গোটা কয়েক ছড়া মিলিয়ে মিলিয়ে লিখে দিলেই হল।আমি বলছি ভোটে জিতলেই আমরা ওকে জেলার সেরা কবি সম্মান দেব।একটা চাকরিও জুটিয়ে দেব।
আর ওই আমিনাকেও টেনে ঢুকিয়ে দেব।
আসলে আমাদের পার্টিতে ভাল কবির বড্ড অভাব।
বিরোধীরা শালা কী সুন্দর সব ছন্দ দিয়ে লিখে যাচ্ছে।বাচ্চারা পর্যন্ত স্কুলে,ইস্কুলে গাইতে শুরু করেছে।এই অবস্থায় রফিককে যদি একবার পেয়ে যায়!...আমাদের জেতা নিশ্চিত।
দুদিন হল রহমান চাচা কথা বলতে পারছেন না। অল্প সল্প তরল ছাড়া কিছু গিলছেন না।
আসলে আঘাতটা মনের শেষ বিন্দুতে গিয়ে লেগেছে বলেই এমন অবস্থা।
সেদিন সাঈদুলের সাথে তার তর্ক করাটা একটু ভুল হয়েছিল।
রহমান চাচা সেইজন্যই আঘাতটা বেশি পেয়েছেন।
দুদিন ধরে রফিক বাড়ি যায়নি।চাচার সেবা করছে।রফিকের মা খাবার পৌঁছে দিয়ে যান।চাচার জন্য দুধ,মধু।
বাইরে দরজায় ধাক্কা শুনে রফিক বেরিয়ে এল।আঙনটা আজ হঠাৎ করে সেজে উঠেছে।
    আমিনা চুনরি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।পরির মতই লাগছে।
  আব্বুর খবর নিতে এলাম।দারগায় এসেছিলাম।আলম গাড়িতেই বসে আছে। ওর এখানের ধুলোয় এলার্জি আছে। তুমি এখানে কী করছ?...আব্বু বাড়িতে নেই বুঝি?
আলম রহমান চাচার কাশির শব্দ শুনতে পেল।সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।কথার খেলাপ সে করতে জানে না।
     উনি বেগুন চারা লাগাতে গেছেন।আমি পানি নিতে এসেছিলাম।
আমিনা একটা কড়কড়ে টাকার গোছা বুকের খাপ থেকে বের করে আনল।
    আব্বুকে বলো।আমি এসেছিলাম।
রফিক বাধা দিল।
    সে সবের কোন দরকার হবে না। আমি আছি তারজন্য ।
আমিনা অল্প তাচ্ছিল্যভাবে হেসে ওঠে গোছাটা আবার রেখে দিল।
    জোড়িটা ভালই হয়েছে।চলি।আমার আবার দেরি হচ্ছে।খুদা হাপিজ।
রহমান চাচা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন।শ্বাস টানছেন।
    ওর এত বড় সাহস...আমার ভালবাসাকে কিনতে চাইছে?...আল্লা..
রফিক বুকের মাঝখানটাই পাম্প করেও রক্ষা করতে পারল না। দেহটা নিশ্চল হয়ে পড়ল।লোকজন ডেকে কবরে নিয়ে যাওয়া হল রহমান চাচাকে।
রফিক কাঁদতে পারল না।
কখনো,সখনো কান্নার জলকেও লুকিয়ে রাখতে হয়।না হলে অন্য কারু ঘর ভেসে যায়।কবিদের কাঁদতে নেয়।যন্ত্রণাগুলো সঞ্চয় করে রাখতে হয়।যন্ত্রণা ছাড়া যে কবি হওয়া যায় না।

No comments:

Post a Comment