Sunday, June 3, 2018

ধারাবাহিক গদ্য - চন্দন ঘোষ



চিকিৎ-"শকিং" ডায়রিঃ রাজনীতির ক্রান্তিকালে বন্ধুত্ব /পর্ব-১


হস্টেলে বেশ সকাল সকাল কাগজ দেয়। আজ সকালে "আজকাল" কাগজটা টেনে নিয়ে দেখতে গিয়ে তো সৌম্যর চক্ষু চড়কগাছ! প্রথম পাতায় ছবিসহ বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা " ইডেন হসপিটালের নার্সারিতে জীবিত শিশুকে মৃত ঘোষণা।" ব্যাপারখানা কী! কাল তো ওর আর তিমিরের ডিউটি ছিল নার্সারিতে। হলটা কী? আজ ভোররাতেও তো কলবুক পেয়ে নার্সারিতে গেছিল সৌম্য। কেউ তো কোনও গণ্ডগোলের কথা বলল না!
#
আসলে ভোররাতে এক ক্যাচাল হয়েছিল নার্সারিতে। কলবুক পেয়ে নার্সারিতে গেছিল সৌম্য। একটা নিউবর্ন মারা গেছে। বাচ্চাটা খারাপই ছিল। সেপ্টিসিমিয়া। ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হবে। সৌম্য সিস্টারকে বলে, বেবি কই, সিস্টার? ঝুনুদি বললেন, সে তো মারা গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল। বাক্সে তুলে দিয়েছি। নার্সারিতে একটা বড়ো কাঠের বাক্স আছে। সদ্যমৃত বেবিকে বাড়ির লোক না আসা পর্যন্ত ওখানেই রাখা হয়। সৌম্য নাছোড়। ওসব হবে না দিদি। বাচ্চা না দেখে ডেথ সার্টিফিকেট লিখব? হরগিজ না। বাচ্চা এল। সাদা কাপড়ে মোড়া। মোড়ক খুলে টেবিলের ওপর রেখে নিয়মমাফিক স্টেথো বসিয়ে এক মিনিট দেখছে সৌম্য। বেবিটা স্থির পড়ে আছে। হঠাৎ বাচ্চাটা নিশ্বাস নিয়ে উঠল। সিস্টারের মুখ ফ্যাকাশে। নার্সারিতে দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেল। সৌম্য বল্ল, করেছেন কি? শিগগির ওয়ার্মারে দিন। অক্সিজেন দিন। ড্রিপ চালাচ্ছি। কিন্তু এ বাচ্চা টিকবে না। ঝাড়া দুই আড়াই ঘণ্টা লড়ালড়ির পর বাচ্চাটা সত্যিই মারা গেল। কী ভীষণ কনফিউশন সৌম্যর। বাচ্চাটা সত্যিই মরেছে তো! তারপর পার্টি ইনফর্মেশন ইত্যাদি করে প্রায় সাড়ে ছটার সময় ক্লান্ত অবষণ্ণ সৌম্য হস্টেলে ফিরেছে। আর ফিরেই এই দুঃসংবাদ!
#
কিন্তু এ তো নিশ্চয়ই অন্য বাচ্চার কিস্যা। কাল সন্ধেবেলা ও আর তিমির ডিউটিতে ছিল। তিমির ওর বুজুম ফ্রেন্ড। এস এফ আই করে। জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের কঠিন সময় চলছে। সৌম্য ওর বিপরীত শিবিরে। ডি এস এ। সে আন্দোলনকারী আর তিমির সরকারপক্ষ। কিন্তু এসব ওদের বন্ধুত্বে চিড় ধরাতে পারেনি। কাল সন্ধ্যায় তিমির আর ও নার্সারিতে খুব আড্ডা দিচ্ছিল আর দুজনেই দুটো সার্টিফিকেট লিখছিল। তিমির লিখছিল একটা সিক রিপোর্ট মানে অসুস্থ বাচ্চার বাড়ির লোককে জানানোর চিঠি আর সৌম্য একটা ডেথ রিপোর্ট। সেখানেই কোনো গড়বড় হয়ে থাকবে। আজকাল সেইরকমই লিখেছে। একেবারে ওয়ার্ডে ঢুকে মায়ের ছবিসহ বক্তব্য ছাপিয়েছে। বাচ্চাটা বেঁচেই আছে। তবে বাড়িতে পুলিশ মারফৎ ডেথ রিপোর্ট চলে গ্যাছে। সৌম্যর স্পষ্ট মনে আছে এই কেসটা তিমিরই লিখেছিল। তবে কি ও-ই কোনো গড়বড় করল? একবার নার্সারিতে যেতে হচ্ছে এক্ষুণি। সৌম্য বিপদের গন্ধ পেয়েছে। এখনও তারই ডিউটি চলছে। সৌম্য নার্সারি রওনা হল।
#
নার্সারি প্রায় ফাঁকা। দিদিদের ডিউটি চেঞ্জ হয়েছে এখনো কেউ কিছু জানে না মনে হচ্ছে। সৌম্য রিপোর্টের রেজিষ্টারটা চেয়ে নেয়। কাল সন্ধের এনট্রিতে পরপর জ্বলজ্বল করছে ওর আর তিমিরের হাতের লেখা। ইশ। তিমির ভুল করে সিককে ডেড বানিয়ে দিয়েছে। কী হবে! সৌম্যর মাথার মধ্যে ঘণ্টা বেজে ওঠে। এই কেস অনেকদূর যাবে। বিশেষ করে আন্দোলনের সময়। টানাহেঁচড়া হবে। কেউ কাউকে ছাড়বে না। সৌম্য কাউকে না জানিয়ে খাতাটা নিয়ে নার্সারি থেকে বেরিয়ে আসে। নিজেকে তো প্রথমে বাঁচাতে হবে। না কি! সে সূর্য সেন স্টীটের চেনা জেরক্সের দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। চুপচাপ  পাতাটার দু-কপি জেরক্স করে নিঃশব্দে নার্সারিতে ফিরে আসে। আহ! এইবার জমবে খেলা। এই কেসটার জিয়নকাঠি মরণকাঠি এখন তার হাতে। (ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment