ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি
তুমি রবে নীরবে
হ্দয়ে থাকবার দিন এপার বাংলার কবির বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে।হ্দয় জিনিসটা শুধু তো নেহাতই একতাল মাংসপিণ্ড ।তার চলনবলন বিজ্ঞানের কল্যানে সকলের কন্ঠস্থ।আজকাল আর কোনও রাস্তার চৌমাথায় ঈশ্বর অপেক্ষা করেন না।কোনও সুতানুটির বামুন পরজন্মে ভূত হতে চান না।হ্দয় নয়।সফল কবির এখন কৃতি মঞ্চের পঙক্তিভোজন বেশি প্রয়োজন ।নীরবে হৃদয়ে থাকবার দিন ফুরিয়েছে ।
অথচ কবিমানসের সঙ্গে নীরব একাকীত্ব নতুন তো নয়।নীরবতার কবি বললেই মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাশের "সাতটি তারার তিমির"-এর কয়েক লাইন।"রাত্রিবেলা বহুক্ষণ মোমের আলোর দিকে চেয়ে, /তারপর ভোরবেলা যদি আমি হাত পেতে দিই/সূর্যের আলোর দিকে -তবুও আমার সেই একটি ভাবনা /অতীব সহজ ভাষা খুঁজে নিতে গিয়ে /হৃদয়ঙ্গম করে সব আড়ষ্ট কঠিন দেবতারা /অপরূপ মদ খেয়ে মুখ মুছে নিয়ে /পুনরায় তুলে নেয় অপূর্ব গেলাস ;"।যেন নীরবেই কবিতা রচিত হচ্ছে কবির নীরবতায়।কবি রণজিৎ দাশ বলছেন, "সহজতার অন্তরালে, কঠিন দেবতাদের অপরূপ মেহফিল।"এই সহজতা তো নীরবই থেকেছে চিরকাল ।তার নীরব সারল্য ।তাকে ছাড়া প্রকৃত কবিতা সৃষ্টি অসম্ভব ।
সভ্যতায় এমন দিনও তো এসেছে,যখন কবিকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে ।শুধুমাত্র সত্যি লিখবার জন্য ।বক্তব্য এমনটাই যে কবির দেখা পৃথিবী বাস্তব পৃথিবী আলাদা।কবির কবিতা অকাতরে সেই বাস্তবোত্তীর্ণ রূপকথা অতিক্রম করে যেতে পারে।এই কারণেই হয়তো কবিদের বলা হয়েছে ভ্যবিষ্যত দ্রষ্টা ।তার কবিতার নীরবতার পিছনে প্রচ্ছন্ন রয়েছে এক সরব বিপ্লব ।শিলার বলছেন ,"আ পোয়েটিক ট্রুথ, বিকজ ইট ইজ আ ট্রুথ ইন দা অ্যাবসলিউট,ক্যান নেভার বি কনগ্রুয়েন্ট উইথ রিয়েলিটি।"
কিন্তু এই প্রসঙ্গে শিলার যে নিষ্পৃহতা তুলে ধরেছেন তা হলো শৈল্পিক ।আধুনিক কাব্যভূবন এক নতুন নিষ্পৃতা পেল।ফিরে যাচ্ছি উপক্রমণিকাতে।সেখানে "এপার বাংলা "শব্দব্যবহার সচেতনভাবেই।তার দুই কারণ।প্রথম ।আমি নিজে স্বয়ং সে গোত্রভুক্ত হওয়াতে সাম্প্রতিক যতোটা সচেতন,ওপারের ক্ষেত্রে ঠিক ততোটা নয়।দ্বিতীয়।ওপারে তবু ভাষার জন্য রক্ত ঝরাবার ঋণ আছে।এমনকি বরাক উপত্যকাও সেই দাবীদার বটে।এপারের বাংলার তরুণ কবির কবিতাপ্রাপ্তিতে সেই বেদনা কোথায়?তাই বদলে গেল নীরবতার বর্ণনাও।যাকে ধরে একদিন বেঁধে বেঁধে চলতে শেখা,সেই মহীরুহর কাণ্ডে কোপ পড়লেও তাই এপারের কবিতা নীরব থাকে।এই নীরবতা জীবনানন্দীয় নয়।বরং একে বলা চলে এলিয়টের শেষ দিককার পরিণতির ঢঙে।"ফাঁপা মানুষ"।একক না রেখে একটা প্রজন্ম উল্লেখ করে দিলে কি খুব ভুল হবে?আধুনিক কবিতায় বিশ্বাস স্থাপন প্রসঙ্গে সমর সেন যেমন এলিয়টের সেই শেষ পরিণতির কথা বলতে ভোলেননি।তাদের ভ্যবিষ্যতে আস্থা রাখা চলে?
এর সমর্পণ প্রতিযুক্তিও নিমেষেই তৈরি করবে প্রজন্ম ।দৃশ্যকল্প ছন্দ মাত্রার মতোই সুযোগের সদ্ব্যবহার সে জানে ।কখন নীরব কবিত্বের আশ্রয়ে আশীষ লাভ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা যায়।এক ধরণের মিডিয়া গেমের মতো।নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সবকটি বোনাস পয়েন্ট তুলে নেবার মতো করেই পুরস্কার সম্মাননা পকেটস্থ করবার কৌশল।মনে পড়ে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ "আত্মপরিচয়"এ কী সাংঘাতিক সত্যি লিখেছিলেন ।"কবি যত বড়ো কবিই হোক,তাহার সমস্তটাই কবি নয়।"নীরবতার আসল কারণ লুকিয়ে ওই বাকিটুকুর মধ্যেই ।সেখানে খানিক গণিত,খানিকটা বানিজ্যতত্ব আর খানিকটা মাৎসন্যায়।এটুকু বুঝলে এই নীরবতা আকস্মিক মনে হবে না।বরং এটুকুই মনে হবে যুক্তিগ্রাহ্য।
লিখতে লিখতে মনে পড়ে গেল অতনুর কথা।অতনু নির্বাক।জন্মবোবা।বামনগাছি স্টেশনে চা বিক্রি করে।অতনুকে তার জন্য ছলনা করতে হয়নি।সেই অতনুও হাতপা ছুঁড়ে দুর্বোধ্য ঈঙ্গিতে জানান দিতে পারে তার প্রতিবাদ যখন রেলপুলিশ অন্যায়ভাবে তার কাছ থেকে হফতা নিতে যায়।আর মনে পড়ে সেই স্ল্যাকটিডিস্টকেও।যে ফেসবুককেই বিশ্বভূবন মনে করে সেখানে যুথিপদ্ম আঁকে।অথচ প্রকৃত সরব হবার সময়ে নীরব থেকে তার বিবর্তন ঘোষণা করে।সাতটি তারার নীরব তিমির থেকে কবি কেমন নীরবতার কবির মিউটেশন করে হয়ে গেলেন নীরব কবি।পাশের বাড়ির মেয়েটা চৌমাথায় রেপট হয়ে ফেসবুকে ভাইরাল হয়।কবি নীরব থেকে জোছনায় পূর্বরাগ খোঁজেন।স্কুলের মাস্টার স্পেশাল এসাইনমেন্টের পর নিরুদ্দিশ্ট মাংসের দলা হয়ে পড়ে থাকে রেললাইনে।কবি তার প্রিয় দশটি কবির কবিতা তার পেজে শেয়ার করেন ও লাইক খোঁজেন।বাহারি মোড়কে তার পূর্বপুরুষের সভ্যতা ন্যাংটা করে দেয় কেউ।আর তিনি বিজন ঘরে সন্ধ্যামালতী চয়ন করতে থাকেন।লিখতে গিয়ে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর "প্রতিস্তব্ধতা" কবিতার প্রথম লাইনটুকু মনে পড়ছে খুব ।"ছিটকে পড়ে কান্না আর আমরা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়ি মোজা পরে নিই হাঁটু পর্যন্ত ।"আমরা এখন ঠিক তাই।নীরবতা নেহাতই একটা অজুহাত ।আসলে আমরা মোজা পরতে ব্যস্ত ।
"রাজা তোর কাপড় কোথায়" বলার মতোই কবি খুঁজে পাই না আর...
ReplyDelete