Sunday, June 3, 2018

গ্রন্থ আলোচনা : অরিজিৎ চক্রবর্তী









গাছ হাঁটছে,পথ হাঁটছে 


মাটির নিচে থাকায় সচরাচর চোখে পড়ে না। কিন্তু শিকড় গাছের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।বিটপ অংশ কেটে দিলে আবার জন্মায়।শিকড় কেটে দিলে গাছ বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে।অথচ গাছ বাঁচলে মানুষ বাঁচে।এই সারসত‍্য বুঝতে আমাদের এত সময় লাগছে যে,শেকড়সমেত আমরা নিজেদের অস্তিত্ব উপড়ে ফেলছি। মানুষের কাছে এ সবই সূচক মাত্র।রূপক মাত্র। অনাবাদী মাঠে পথ হারিয়ে বিশ্রাম করছে যে পর্যটক বৃক্ষ তাকে মানুষ হত‍্যা করছে।আর এই মৃত্যুর কিনার ঘেঁষা অস্তিত্বের চেতনায় হঠাৎই যম এসে পড়ে প্রশ্ন গুলো নিয়ে, নিজের সন্মুখে বসে থাকে নিজে। নচিকেতা নিজেই কি যম, এই বিমূঢ় প্রশ্ন থেকে যায়! কখনো কালের চেতনার ভেতরে চলে গিয়ে এই অস্তিত্বের মুখোমুখি হতে হয়।
আমরা এন.এইচ.-৩৪ ধরে এগিয়ে চলি এন.এইচ.-৩৫ দিকে। যশোর রোডের আশ্চর্য রূপবীথির সান্দ্র ছায়া পথে সাতচল্লিশের ছেড়ে যাওয়া ধোঁয়া ভেসে যায়। আমি বিক্রমপুর আর কলকাতার একটা ফ‍্যাক্সিমিলি সমাচ্ছন্নতা অনুভব করি।
দেখি ভারত বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র রচনায় এই পথের প্রবহ অনন্ত ! সজল চক্ষুদ্বারা সমগ্ৰ সড়ক পরিবেশটাই যেন আর্দ্র ও ছলছল করছে প্রাত‍্যহিক অতীন্দ্রিয়তায়। তথাপি আধুনিক উন্মেষের মিথ্যা প্ররোচনায় দু'শো বছরের উদ্ভিদ-উপনিষদ কেটে ফেলার সিদ্ধান্তে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বনগাঁর ১নং রেলগেট সংলগ্ন যশোর রোডে শুরু হয় গাছকাটা। এপিডিআর জনস্বার্থের মামলা করে। হাবড়ার তরুণ কবি ঋপণ আর্য ১ এপ্রিল ফেসবুক বার্তায় বৃক্ষনিধনের বিরোধীতার কথা জানান। ২এপ্রিল স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা মোমবাতি জ্বালায় নিহত বৃক্ষের গুঁড়ি ঘিরে। শপথ নেয় এই অন‍্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের।
লড়াই বীজ থেকে মহীরুহ হলো। এগিয়ে এলেন এলাকার সংবেদনশীল মানুষ জন। কবি, শিল্পী,নাট‍্যকর্মী, সঙ্গীত শিল্পী, সাংবাদিক, শিক্ষক।
কবি লিখলেন কবিতা, শিল্পী আঁকলেন ছবি। প্রতিবাদের তুমুল ক্লোরোফিলে গাছের ধারণা ক্রমশ কবিতাকে অধিকার করে নিল। গাছের মধ‍্যবর্তীতায় কবি বিভাস রায়চৌধুরীর  আবিষ্কার করলেন জনপদকে---তার অতিশায়ী চেতনাকে।
"মানুষ ভুলেছে সব! মানুষের মনে নেই আর
খন্ড খন্ড গাছেদের জড়িয়ে ধরেছে শিশু,
তাদের কান্নার নাম বোবা চিৎকার..."
এই পঙক্তির স্হানবাচকতাকে অঙ্গীকার করেও প্রাণাকাশের দিকে,সহৃদয়তার দিকে অগ্ৰসর। তাই রাহুলের কিংবা বরুণের স্পন্দিত বিপ্লবে যশোর রোড ও তার সমগ্ৰতা কবির উচ্চারণে সর্বকালের মানুষের মনের কথার সঙ্গে একীভূত করে দিল।ভ্রুণরূপে বীজবদ্ধ নতুন জীবন আবরণ অতিক্রম করে উজ্জীবনের অমরত্বে আমাদের পৌঁছে দিল  নতুন অপেক্ষবাদের প্রজ্ঞায়।
"রাহুল হাঁটছে আর রাহুলের ভেতর বরুণ
রেখে দিচ্ছে চুপিসারে লুপ্ত নদী...চালুন্দিয়া নাম...
আকাশে আকাশ থাকে,পথে জুটে যায় ছেলেমেয়ে!
রোদে পুড়ে ঘাসে ভিজে কত কত বাঁক পেরোলাম..."
কবিকেও আত্মচৈতন্যের ক্রনোটোপে স্হানকালকে ধারণ করে কত কত বাঁক পেরোতে হয়!
মাফিয়া মানুষ, তীব্র ঘাতক, অশান্তির বিষ এই সমস্ত বেপথুমানতার বিপরীতে আত্মদীপ জ্বেলে কবি নির্বিশেষ মানুষ আর নির্মিশেষ মানুষের ভালোবাসার সুচেতনাকে জাগরুক করে তোলায় প্রত‍্যাশী হন। আমাদের বলে দেন, "ঘাতক অবাক!দ‍্যাখে ব‍্যর্থ হয়ে গেছে সব খুন... / ওই তো হাঁটছে গাছ, লুপ্ত নদী এবং বরুণ!"
হ‍্যাঁ, বরুণের মতো অজস্র বরুণের অনুসারী পথ চলা শুরু হয়েছে। যশোর রোডের গাছে গাছে উন্মিলিতা নিমিলিতার সংরাগ।ঋপণ আর্যের পোস্টকার্ড অক্ষরের নিষেক ঘটিয়ে কবিকে দিয়ে লিখিয়েছে কবিতা।এক আর্ত প্রতীক্ষায় নৈঃশব্দ‍্যের ডাকঘরে ডেকেছে ডাহুক!পথে দেখা হয়েছে প্রলয়ের সাথে।প্রলয় মুছিয়ে দিয়েছে ঋপণের ছলোছলো চোখ! কলোনিপাড়ার শিল্পী বাসুদার সারল‍্যে ভাষাই আদতে গাছের শিকড় হয়ে গেছে।অনুপম এসেছে।পোস্টার ঝুলিয়ে রাস্তায় নেমেছে গাছ-দেবাশিস!
এতটা পথ আসার পর মনে হলো, অনন্তের 'আমি'র বুদ্ধবাদে জীবনের কাল চেতনার যে পরিচয় ছিল-- বিশেষ করে ক্ষণিকতার ধারণা-- কবিতার সমর্থ চিত্রকল্পে সমীচীন বিষয়াশ্রয় হতে পেরেছে। সঙ্গে শিল্পী বিপ্লব মন্ডলের তুলির চেতনা টান আমাকে বিস্মিত করেছে বইকী। তাই তিনি জানিয়ে দিচ্ছেন,"যে কোন হত‍্যা দৃশ্যই আতঙ্ক তৈরি করে।গাছ কাটার অসাধু মানুষ জন কিংবা করাতের কলরব তাঁর ছবির অনুকৃতি নয়। শিল্পী দেখছেন স্বপ্ন রঙের রেখাপাতে পাখির কলকাকলির সম্ভাবনা। খোঁজার ভাষায় শিল্প সুলভ গাছের শিকড়!

গ্রন্থ- যশোর রোডের গাছ
বিভাস রায়চৌধুরী
প্রচ্ছদ ও চিত্র- বিপ্লব মণ্ডল
ছোঁয়া প্রকাশন
২৫০টাকা

No comments:

Post a Comment