ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি
বধ্যভূমিতে কে দাঁড়িয়ে?
বধ্যভূমিতে কে দাঁড়িয়ে?
একখানি শরের কলম নিয়ে তালপাতার ওপর কবি
লিখে চলেছেন। প্রখর গ্রীষ্ম। চারিদিকে আগুনের হলকা । বাতাস থমকে গেছে। কপালের ওপর
নেমে আসা স্বেদ বিন্দু অন্যমনস্ক ভাবে সরিয়ে দিলেন কবি। অবিন্যস্ত চুল নেমে এসেছে কপালের ওপর । একটু
পরেই রাজার লোক আসবে কবির পর্ণ কুটিরে। কবি একবার চোখ বন্ধ করলেন। মনশ্চক্ষে দেখতে
পেলেন নিজের বধ্যভূমি। দু’হাত প্রসারিত করে হাসি মুখে এসে দাঁড়ালেন জল্লাদের
সামনে। একটা তিক্ষ্ণ কাঠের দন্ডের ওপর কবিকে বসানো হল। ধীরে কবির মুখে যন্ত্রণা
ফুটে উঠল । কবি মুখে স্মিত হাসি ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলেন না । সুতীব্র
যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন মুহূর্তের জন্য। ধীরে ধীরে কবির চিৎকার থেমে গেল ।
প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরে বাতাস থমকে দাঁড়িয়ে গেছে । চারিদিকে অদ্ভুত নীরবতা। রাজা
নেমে এলেন সিংহাসন থেকে। কবির পায়ের কাছে পড়ে থাকা শরের কলমটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে
ফেলে দিলেন শূলের পাশেই থাকা কূপের গর্তে। আর কিছুক্ষনের মধ্যেই কবির মৃত শরীরকে
নামিয়ে দেওয়া হবে ঐ অন্ধকার গর্তে। দৃশ্যটুকু ক্রমশ স্পষ্ট হতে হতে একেবারে সামনে
এসে দাঁড়াল। রাজার সৈন্যদল এসেছে কবিকে নিয়ে যেতে। তালপাতার পুঁথিখানি স্ত্রীর হাতে দিয়ে হাসিমুখে চললেন সৈন্যদলের
সঙ্গে । একটু আগে দেখা দৃশ্যটি তখনও তার স্মৃতিতে জেগে। তবুও মুখের হাসি অমলিন।
কবি ধীরে ধীরে বধ্যভূমিতে এসে
দাঁড়ালেন।
রাজার
সৈন্য জেগে থাকে রাস্তায় রাস্তায়।
রাজার
সৈন্য জেগে থাকে সতর্ক পাহারায়।
তবে বধ্যভূমির মাটি এখন ভীষন রকম ভালো।
সেখানে অনেক ফুল ফুটে আছে। জল্লাদের ছুটি হয়েছে বহুকাল। আপৎকালীন সময়ে জল্লাদের
ভূমিকায় নেমে আসতে পারেন স্বয়ং রাজা। তবুও তিনি খুব একটা রক্ত মাখতে ভালোবাসেন না
বলেই কবিরাও বেশ নিশ্চিন্তে আছেন। চাঁদ তারা ফুল পাখি জ্যোৎস্না শ্যাওলা বা কবির
প্রেমিকার মুখ আর রাজার সুশাসনের কথা লিখে অথবা মুখে মুখে গান বেঁধে বেশ আনন্দে
আছেন। অথবা একদল কবি যশোপ্রার্থীর দল বধ্যভূমি থেকে শীতের দুপুরে বনভোজন করে ফিরে
এসে নীরবতা ও স্তাবকতার চাদরে নিজেদের মুখ ঢেকে লিখে ফেলছেন আলোকময় কবিতাগুচ্ছ। যদিও
রাতের অন্ধকারে পাহারাদার আর হানাদারি চোখ টপকে এক আধজন পৌঁছে যাচ্ছেন সেই
তালপাতার লাল অক্ষরে লেখা পুঁথির কাছে কিন্তু তাদের চিহ্নিত করে দেওয়ার নিরন্তর
খেলাও বেশ জনপ্রিয়। কে কত কাছাকাছি আসে রাজার তার এক সুতীব্র প্রতিযোগিতা।
রাজা
সবারে দেন মান
সে
মান আপনি ফিরে পান।
রাজা সপরিবারে বধ্যভুমি দর্শনে যাবেন ।
সঙ্গে থাকবেন কেবল তরুণ কবির দল। রাজা প্রত্যেককে একটি করে মোহর আর কলম দিলেন।
সোনার কলম।
বধ্যভূমি ফেরৎ কবির দল সনেট লিখলেন। রাজা
খুশি হলেন । তালপাতার সেই পুঁথির খোঁজ করতে চাইলেন রাজা । তরুণ কবির দল উৎসাহ ভরে
জানালেন ঐ পুঁথি আর তো নেই । অথবা থাকেও যদি তার কথা কে আর জানবে। রাজা সামান্য ভয়
পেলেন। ছদ্ম রাগে একটু একটু করে ফেটে পড়ার নিখুঁত অভিনয় করলেন। আগামী দিনে
জল্লাদের প্রয়োজন হলে আবার তাদের ডাকা হবে জানালেন। পরিশেষে কবির দলকে একটি করে
মোহর দিলেন । ধীরে ধীরে রাজসভায় নীরবতা নেমে এল। তরুণ কবির দল কবিতা লেখায় মগ্ন
হলে রাজা নেমে গেলেন প্রজাদের কাছে।
মায়াভরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন আগামীর
উৎসবে আসবে তো সব?
প্রজার দল বলতে চাইল ধান হয়নি এই বছর।
রাজার সৈন্যদল ঘন হল।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন তোমরা এত নীরব কেন
, কিছু তো বলো ?
প্রজাদের ভিতর গুঞ্জন উঠল। এই বছরের কর
যদি মুকুব হয় !
রাজার
সৈন্য থাকে সতর্ক পাহারায়
রাজার
কবি থাকে সচেতন নীরবতায়।
রাজার চোখ থেকে ঠিকরে উঠল রাগ ।
জল্লাদের মুখ ছায়া ফেলে মিলিয়ে গেল নিমেষে।
রাজা বধ্যভূমিতে এসে দাঁড়ালেন। তিনশো
সৈন্যের সতর্ক পাহারায় কর মুকুবের আবেদন করা চাষীদেরকে আনা হল।
রাজা হাসলেন। কবি হাসলেন। কবি চাঁদ
তারা ফুল পাখি নদী নিয়ে সনেট লিখলেন।
কর মুকুবের অধিকারের কথা লেখার কথা ছিল
না তার। কবি কখনও চাষ করেননি । অথচ তার মোহরের অভাব নেই।
কবি কি নীরব থাকাকেই তার ভবিতব্য বলে
মেনে নিলেন তাহলে। না কি সনেটের আড়ালে নীরবতাকেই মনে করলেন সর্বশ্রেষ্ঠ আশ্রয়।
রাজা তাকে বধ্যভূমি দেখিয়ে এনেছেন। রাজা তাকে মোহর দিয়েছেন। রাজার সৈন্য থাকে
সতর্ক পাহারায়। কবির অক্ষরে অক্ষরে ভয়
নাকি সচেতন সাবধানতা !
নির্জনতা আর নীরবতা দুই-এর দ্বন্দে কবি
নিজেকে এনে ফেললেন বধ্যভূমিতে। রাজার রূপ পরিবর্তিত হতে হতে সে আজ মুখোশ ছুঁড়ে
ফেলে দিয়েছে। কবিও সেই জল্লাদের চেহারা দেখে আরও সাবধান হয়েছে । মোহরের হাতছানি তো
আছেই তার সঙ্গে আছে সোনার কলম উপহার পাওয়ার স্বপ্নিল সুযোগ।
রাজার
সৈন্য এখনও পাহারাদার
শব্দ
অক্ষরে ভাষার গুপ্ত হানাদার
অবশেষে কবি নীরবতাকেই শ্রেয় ও বেঁচে
থাকার আশ্রয় বলে বেছে নিলেন।
রাজাও তার নাম পরিবর্তন করে হয়ে উঠলেন
তোমাদের দ্বারা তোমাদের জন্যই আর তোমাদেরই লোক।
কবিগণ খুশিয়াল নীরবতা নিয়ে সেঁধিয়ে
গেলেন নিরাপদ দূরত্বে। প্রজারা কর মুকুবের দাবি নিয়ে এসে দাঁড়ায় একা । বধ্যভূমিতে লেখা
থাকে গ্রেফতারি পরোয়ানা। কবিগণ ভয় পেয়ে কলম অথবা কীবোর্ড রেখে দেন । অথবা চাঁদ
তারা ফুল পাখির সনেট লেখেন।
রাজা ক্রমশ তোমাদের থেকে রাজা কেবল
কয়েক জনের হলেও কবি জ্যোৎস্নার ছবি এঁকে ঘুমোতে যান ।
রাজা রাষ্ট্র হয়ে উঠলে কবিরা আহ্লাদিত
হন ।
রাষ্ট্র চোখ রাঙালে কবিরা নিরাপত্তা
খোঁজেন।
রাষ্ট্র জল্লাদ খুঁজে আনলে কবিরা নিরব
হন।
অথচ কবিদেরই দরকার ছিল নীরবতা ভেঙে উঠে
দাঁড়ানোর। চাঁদের গায়ে চরকার দাগ দেখে আহ্লাদিত না হয়ে রাজাকে জিজ্ঞেস করা উচিত
ছিল একটা পোড়া রুটির দামে কেন জিএসটি লাগু হয়। কেন তালপাতার পুঁথি খুঁজে না পেয়ে
কবিকে অথবা সাংবাদিককে তুলে আনা হবে বধ্যভূমিতে অথবা তার বাড়ির মেঝেই হয়ে উঠবে
বধ্যভুমি? কেন কৃষককে দাগিয়ে দেওয়া হবে বিছিন্নতাবাদী শক্তির প্রতিভু বলে ? কবি
আপনি নীরবতা খোঁজ করে যান অথবা সোনার মোহর। আপনার জন্য রাখা থাক একটা কবিতা উৎসব
অথবা জল্লাদ। প্রয়োজন মতো বেছে নেবেন শুধু।
তবে আপনারই তো উচিত ছিল সেই তালপাতার
পুঁথির খোঁজ করা। সেই নির্ভিক কবির নীরব চিৎকার থেকে রাগ ক্ষোভের সন্ধান করে তুলে এনে ছড়িয়ে দিতে
পারতেন রাজার সামনে। নির্লজ রাষ্ট্রের সামনে নতজানু হলেন কেন? বধ্যভূমির ভয়ে নাকি
একখানি সোনার উত্তরিয় বা মোহরের লোভে অথবা নেহাতই নিজেকে ছাপোষা মধ্যবিত্ত কেরানি
মনে করে রাজার পাহারদারের হানাদারি আক্রমণ থেকে নিজেকে ও পরিবারকে বাঁচাতে অন্ধকার
কুঠুরিতে ঢুকে গেলেন ?
অথচ আপনার হাতেই ছিল সেই জাদু দন্ড যার
নাম কলম ।
একবার সাহস করে ব্যবহার করেই দেখতে
পারতেন বধ্যভূমিতে কে কাকে দাঁড় করাত?
পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিটাকে কলমের খোঁচায় খুব সুন্দরভাবে আঁকা হয়েছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete