Tuesday, June 5, 2018

নীরবতার নাস্তি: বিশ্বজিৎ রায়

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি





                                                             নীরবতার নাস্তি


সভ্যতা নীরবতা ও অন্ধকার বিরোধী। সভ্যতা সশব্দ গতি ও আলোকিত রাত্রি  অর্জন করেছে। এই আলো ও শব্দ কবিদেরও আলোড়িত করে। কবিদের মধ্যে যাঁরা বদলে যাওয়া সময়ের তাৎক্ষণিক চরিত্রকে  ধরতে চান তাঁরা শব্দের অনুকারী, সর্বার্থেই। ঈশ্বর গুপ্ত সাহেবি খানা-পিনার সশব্দ চিত্র তাঁর পদ্যে প্রকাশ করেছিলেন। সাংবাদিক কবির ধর্মই তা – পানপাত্রের শব্দ, তোপধ্বনি, ইংরেজি নাচ-গান সেকালের কলকাতা তখন সবে শুনছে। ঈশ্বর গুপ্ত তা লিখছেন – কবিওয়ালাদের দলের লোক বলেই শব্দালংকারের বাহুল্য তাঁর পদ্যে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ছেলেবেলা’ বইতে আবার গোড়ায় একটি পদ্যে স্মরণ করেছিলেন উনিশ শতকের কলকাতার হারিয়ে যাওয়া শব্দের কথা। সভ্যতা এগোলে পুরনো শব্দ হারায়, নতুন শব্দ জাগে। মানুষের ভাষা ভঙ্গি বদলায় – সেই বদলে যাওয়া ভঙ্গির শব্দও আবার ধরতে চান কেউ। হাতে গরম  শব্দ ভিড় করে বাংলা কবিতায়।    

সভ্যতা নীরবতা ও অন্ধকারকে মুছে ফেলে বলে নীরবতা ও অন্ধকারের পক্ষ নিতে পারেন কেউ কেউ। নীরবতার পক্ষ নেওয়া একদিক থেকে সরলরৈখিক সশব্দ উন্নয়নের বিরোধিতা করা। বাংলা কবিতায় এই নীরবতার পক্ষ নেওয়া কবিদের আজকাল আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। তাঁরা কবিতার সশব্দ-জনপ্রিয়-উৎসব থেকে দূরে থাকেন। তাঁদের কবিতা আবৃত্তি করার মতো নয়, তাঁদের কবিতা একা একা পড়ার কবিতা। পড়তে পড়তে বোঝা যায় তাঁরা আসলে কমকথায় আঁকছেন এমন কিছু ছবি যা নব্বই পরবর্তী খোলাবাজারের তাণ্ডবের বিরুদ্ধ জীবনযাত্রা থেকে উঠে আসছে। যদিও মূলস্রোতের অর্থনীতির সমর্থকেরা মনে করেন এই সব ছবি হেজে-মজে যাবে, এই নীরবতার কবিরা  তা কিন্তু বিশ্বাস করেন না।তাঁরা জানেন এই সব ছবির মধ্যে ব্যর্থতা আছে, হেরে যাওয়া আছে। তবে জিতে যাওয়ার ইচ্ছে নিয়ে এগোয় যারা তারা বুঝতেও পারে না হেরে যাওয়া অপূর্ণতাও হতে পারে কারও অস্তিত্বের সারাৎসার। 
বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে কয়েকটা ছবি।
আর কিছু নয়
বাড়ির সামনে একটা তালগাছ –
                  এই।
ঝাঁকড়া-মাথা সন্ধ্যা নামছে বাবুইয়ের বাসা থেকে
আর আমতলায়
বুক-অব্দি-রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে
আমার ঠাকুর্দার অপূর্ণ ইচ্ছা।

কে জানে
জ্যোৎস্নার ভেতরে আজও গাঁথনি উঠবে কিনা।(গাঁথনি)
এ লেখা একটা গল্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিভূতিভূষণের ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’। সে বাড়ি কোনওদিন শেষ হয় না। এও শেষ না হওয়া বাড়ির গল্প। পাখিদের বাড়ি যেভাবে হয় সেভাবে কি মানুষেরা বাড়ি গড়তে পারে? পারে না। বাবুইয়ের বাসা থেকে নেমে আসা সন্ধে বুক-অব্দি ওঠা রান্নাঘরে থমকে দাঁড়ায়। ঠাকুর্দা কি পেরেছিলেন তিলে তিলে বাকিটুকু গড়তে? জানা নেই। জ্যোৎস্না বড়ো মায়াময় – সে আশার আলো নিয়ে আসে। সে আলো আর মায়া পূর্ণতা নাও পেতে পারে। এই না-হওয়া বাড়ির মধ্যে জীবনের যে স্পন্দন ছিল তা জানে না নব্বই পরবর্তী ‘হোম-লোন’। অথবা হোম-লোনের গল্পে সকলেই আছে বলে এই বুক-অব্দি-রান্নাঘর মুছে দেয় ক্রেডিট ইকনমি।
বিশ্বদেব সেই মুছে দিতে চাওয়া জীবনের অস্তিত্বকে তাঁর কবিতায় নীরবে নিয়ে আসতে চান।
আরেকটা ছেড়ে যাওয়া বাড়ির ছবি দেখা যাক।
সব্বাই ভুলে গেল –
এইখানে একদিন সোনাদি’রা ছিল।
এইখানে একদিন
      একটা উঠোন ছিল, চারিধারে এক বুক উঁচু
ইঁটের পাঁচিল ছিল, একসার ডাব গাছ ছিল, তার
      ছায়ার ভেতরে চুল মেলে দিয়ে সোনাদি হঠাৎ
ভিন গাঁয়ে চলে গেল।(সোনাদি হঠাৎ কেন)
খেয়াল করার মতো ‘ছিল’ শব্দটি। অতীতকাল – একতলা বাড়িগুলি সবই ক্রমশ অতীত কাল। ডাব গাছের ছায়ায় চুল মেলে দেওয়া দুপুর অতীতকাল। দুপুরের নীরবতাকে চুলের ভেতরে গাছের ছায়ায় বুনে নিত যারা সেই মেয়েদের যাপন এখন ক্রমশ অতীত। বিশ্বদেব জানেন দুপুরের আগে বসাতে হয় ‘চুপি চুপি’। এই নীরব দুপুরে আইবুড়ো মেয়েদের শরীরযাপনের অলস-বিভঙ্গ। সেই সব নীরব, চাপাপড়া, মায়াবি, হতশ্বাস। তখনও এমন করে সোচ্চার বিকল্প যৌনতার থাবা বাঙালি রমণীদের দুপুরগুলোকে ভরিয়ে দেয়নি। এমন দুপুরেই কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে দিদির ডুবে যাওয়া।

‘কোথাও যাসনে’ – বলে চুপি চুপি দুপুরে হঠাৎ
পুকুরের মাঝখানে
ঝুপ ক’রে ডুবে গেল দিদির বয়স।(হিংসুটি)
দুপুরের পুকুরের মতোই বাঙালি জীবনে নিথর-নীরব আরেকটি অবলম্বন ছিল, সে ইঁদারা। দুপুর আর রাত ছিল তার একান্ত সহচর। প্রশ্ন জাগে। অমোঘ প্রশ্ন।
কে
রোজ
চুপি চুপি বালতি নামায়?(ইঁদারা)
এ যেন অনন্ত কুয়ো, মানুষের নিজের ভেতর। সেই ভেতরের নীরব কথা আর বোধ জানতে গেলে হতে হবে রসিক, সহৃদয়। সকলের বালতি নামানোর অধিকার নেই। নিত্য প্রয়োজনে আসে যারা তারা কুয়োতলায় ঢেউ তোলে – কাজের ও কথার। তারপর একসময় সব চুপচাপ। রাত নামে, নিশুতি রাত। তখনই তো রোজ রোজ নিজের রসিক শরীরে চুপি চুপি বালতি নামানো। এ সাধনা সশব্দ সভ্যতা জানতেও চাইবে না। রাত কত আলোময় হতে পারে কত উল্লাসপ্রবল তার ওপরেই তো নির্ভর করে পণ্যের আনাগোনা।
ইঁদারার ছবি তাঁর কবিতায় বাড়ির ছবির মতোই ফিরে ফিরে আসে।
বিশ্ব তাহলে এই।
        চন্দ্রবোড়া সাপের মতন
বহু দূরে ছায়াপথ
নিকষ দীর্ঘ কাণ্ড হেলে আছে জলের উপরে।
                          ইঁদারায়
রাত বাড়ে –
মুণ্ডহীন
একা।(কবন্ধ)
এই কবিতায় অন্ধকার মুখ্য। ইঁদারার জলে হেলে থাকা তালগাছের অন্ধকার ছায়া পড়েছে। ইঁদারার সঙ্গে সে গাছের সম্পর্ক কী? ছায়া পড়লেও কি একাকিত্ব যায়? ছায়াপথের অজস্র গ্রহ তারার মধ্যে এই বিশ্ব একা। একাকিত্বের এই উপলব্ধি দার্শনিকতার বোধে দীপ্ত। জাগতিক সভ্যতার বিরুদ্ধে কেবল উচ্চকিত প্রতিবাদ অর্থহীন। নীরব বিপরীত হারিয়ে যাওয়া এবং মুখ লুকিয়ে থাকা জীবন ও সময়ের  ছবি আঁকতে আঁকতে বিশ্বদেব উপনীত হন সেই উপলব্ধিতে যেখানে ‘সমস্ত অস্তি দ্যাখো ধীরে ধীরে ঢুকে যাচ্ছে অনন্ত নাস্তির ভেতরে’ ( সংখ্যার ভেতরে) এরপর আর কথা চলে না। তাঁর কবিতাকে শুধু গোলকায়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বললে খণ্ডিত করা হয়। তাঁর কবিতা, তাঁর নীরবতা ও অন্ধকার একদিক থেকে প্রতিবাদ। তবে সেই প্রতিবাদের প্রেক্ষাপটটি ‘অনন্তের ইশারা’ সমন্বিত। সেই  ইশারা আসে বলেই এই বিশ্বাস প্রখর – অনন্ত নাস্তিই সত্য। গোলকায়ন সাময়িক খেলা ছাড়া কিছু নয়।  
শেষে দুটি টিপ্পনী। তাঁর ‘হলুদ বনে কলুদ ফুল’ কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত। এমন নীরবতার ইশারাময় প্রচ্ছদ খুব কমই দেখেছি। বিশ্বদেবের কবিতা যে নাস্তির কথা বলে তা একরকম ভাবে তাঁর গীতাভাষ্য। সে ভিন্নতর আলোচনার বিষয়।    



    

2 comments:

  1. চমৎকার। কবিতা নিয়ে বিশ্বজিৎদার লেখা খুব বেশি চোখে পড়েনি। এমন লেখা আরও চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। অংশুমানদের কৃত্তিবাসে এই সংখ্যায় মণীন্দ্র গুপ্তের লেখাপত্র নিয়ে নিবন্ধ লিখেছি, আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখি নিয়ে। বইমেলায় রক্তমাংসেও লেখার বিষয় ছিল কবিতা। কবিতা নিয়ে কম লিখি, তবে মাঝে মাঝে লিখতে সাধ হয়।

      Delete