ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি
দু’দিকে জ্বলে থাকা মোমবাতি ও পোড়া জীবন
দু’দিকে জ্বলে থাকা মোমবাতি ও পোড়া জীবন
‘সৃষ্টির ভিতর মাঝে মাঝে এমন শব্দ শোনা যায়, এমন বর্ণ
দেখা যায়, এমন অঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন মানুষের বা এমন অমানবীয় সংঘাত লাভ করা যায়
কিংবা প্রভূত বেদনার সঙ্গে পরিচয় হয়, যে মন হয় এই সমস্ত জিনিসই অনেকদিন পর্যন্ত,
হয়ত মানুষের সভ্যতার শেষ জাফরান রৌদ্রালোক পর্যন্ত, কোথাও যেন রয়ে যাবে ...
কবিতা মূখ্যত লোকশিক্ষা নয়; কিংবা লোকশিক্ষার রসে মন্ডিত করে পরিবেশন
– না, তাও নয়; কবির সে রকম
উদ্দেশ্য নেই। কিঙ লিয়ার কিংবা বলাকার কবিতায় – এবং পৃথিবীর সমস্ত শ্রেষ্ঠ কাব্যেই কবির
কল্পনা-প্রতিভার বিচ্ছুরণে, কিংবা তার সৃষ্ট
কবিতার ভিতর সে রকম কোনো লক্ষ্যের প্রাধান্য নেই। …
এই প্রসঙ্গেই ব্যক্তি সমাজ ও সভ্যতার সঙ্গে কবিতার দ্বিতীয়
সম্বন্ধের কথা ওঠাতে পারি। কথাটা হয়তো স্বাদহীন শোনাবে, কিন্তু আমার মনে হয়, তা সত্য। কবিতা সকলের জন্য নয়, এবং যে পর্যন্ত জনসাধারণের হৃদয় নতুন
দিগবলয় অধিকার না করবে সে পর্যন্ত কয়েকটি তৃতীয় শ্রেণীর ‘কবি’র স্থূল উদ্বোধন ছাড়া বাজারে ও বন্দরে – এবং মানব সমাজ
ও সভ্যতার সমগ্রতার ভিতর কোনো প্রথম শ্রেণীর কাব্যের প্রবেশের পথ থাকবে না…’ (কবিতার কথা / জীবনানন্দ দাশ)
জীবনানন্দ দাশের এই সুবিখ্যার প্রবন্ধের প্রতিটা পঙতিই
আমাদের আবিষ্কারের আনন্দ দেয়। এই গদ্যের কাছে বারবার ফিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে যেতে
হয়। অনেকেই জীবনানন্দের কবিতার মতই তাঁর অননুকরণীয় গদ্যে ছেয়ে থাকা দূর্বোধ্যতার
কথা বলেন। প্রকাশ্যে যতটা না, তার থেকে বেশী আড়ালে। আসলে এটিও আমাদের পাঠাভ্যাসের
মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক কর্কট-প্রবণতা। জীবনানন্দের গদ্যে সেই দূর্বোধ্যতা লুকিয়ে
নেই। সেটি লুকিয়ে আছে আমাদের পাঠাভ্যাসের মধ্যেই। কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি বিষয়ক
যে সংকট মাঝে মধ্যেই ঘনিয়ে ওঠে আমাদের চারপাশে, যা আমাদের কাব্যজগত ও মেধাকে আক্রমণ করে ঘূর্ণির সৃষ্টি করে তার
উত্তর অনেকটাই লুকিয়ে আছে এই প্রবন্ধটির ছত্রে ছত্রে।
কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি – এই আপাত নিরীহ শব্ধগুচ্ছটির মধ্যে লুকিয়ে আছে
এক পারাপারহীন ফাঁদ। এমন একটি গূঢ বুবিট্র্যাপ যার দু’দিকেই আগুন- জ্বলা,
বেঁকে চলা একটা রাস্তা। মাত্র চারটি শব্দের মধ্যে যে যুক্তির
অবসর ক্যামোফ্লেজ করে আছে সেটির থেকে কোনও একটি একরৈখিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো প্রায় আসম্ভব। রাষ্ট্র, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি থেকে শুরু করে নন্দনতত্বের অঙ্গন পেরিয়ে
সেটি ছুঁয়ে থাকে ব্যক্তি মানুষের বিপন্নতা ও বিষন্নতাকেও। একজন স্রষ্টার যে মৌলিক বিষাদ বা আনন্দ, যার থেকে ক্ষরণের আকারে ঝরে পড়তে থাকে তার সৃষ্টির মৌল-উপাদান, সেই কোর-এরিয়া ছুঁয়ে থাকে
যে কয়েকটি মৌলিক ‘ফ্যাক্টর’ তার মধ্যে অবশ্যই
একটি হলো ‘কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি’। হেয়ারপিন বাঁক পেরুলেই যেমন পাহাড়ের ঢাল তার বহুরৈখিক চিত্র ও চিত্রের সম্ভাবনা
নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে … ঠিক তেমনই এই শব্দগুচ্ছটি
অতিক্রম করলেই আমাদের সামনে ফুটে উঠতে পারে অনেকগুলি বাস্তব ও সম্ভাব্য-বাস্তবের ছবি। কোড ল্যাঙ্গুয়েজের মত বারংবার ডিকোড ও ডিসাইফার করে করে
আমাদের অগ্রসর হতে হয়। এবং প্রতিবার ডিসাইফার করবার পর জেগে ওঠে আরেকটি সম্ভাব্য
পরিনতি ও পথের ছবি।
যে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনারত সেই বিষয়টির দিকে তাকালে
প্রথম যে দুটি শব্দ চোখে পড়বে, ‘কবির নীরবতা’, সেই দুটি শব্দ আপাতভাবে নিরীহ মনে
হলেও পরের দুটি শব্দের থেকে তারা অনেক বেশী প্রতারণাময়। অনেক বেশী আপেক্ষিক। এবং
যে কোনও আপেক্ষিক বিষয়ের মতই এই শব্দদুটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি (বা তার থেকেও
বেশী) দিক থেকে বিশ্লেষন করা যায়। তার থেকেও বড় কথা, সবকটি আলোকসম্পাতই পৃথক পৃথক
পথের বা সম্ভাব্য পথের সন্ধান দিতে পারে।
একজন কবির নীরবতা তার শিল্পের অধিকার।
সে একমাত্র ঋণী তার মাধ্যমের কাছে। সেখানেই সে তার নীরবতার থেকে বেরিয়ে
প্রকাশের পথ করে নেয়। একজন কবি যখন তার কবিতার প্রথম শব্দটি লিখছেন তখনই তিনি
নীরবতা থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়লেন। প্রতিটা শব্দে এবার তাকে ঢেলে দিতে হবে শব্দের ভিতর লুকিয়ে
থাকা আলোকে। ‘কবির নীরবতা’ শব্দদুটিকে যদি এই পথে ডিসাইফার করা যায়
তাহলে আমরা পৌঁছে যাই সেই সিদ্ধান্তে যেখাবে কবি ভয়ংকর ভাবে একা একজন মানুষ। সব শিল্পীই মূলত একক মানুষ। পারাপারহীন ভাবে একা। প্রতিকূলতার সাধক। স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই তাকে লিখে যেতে হয়। মাঝে মাঝে কাল্পনিক সত্য ঘটনার মত অনুকূল
পরিস্থিতির সন্ধান পেলে অনেকেই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে কবিতার অন্দরমহলে প্রবেশ
না করে যারা কবিতাকেন্দ্রিক নানা বিষয়ে মনোযোগ দিতে পছন্দ করেন এবং শব্দসাধকের ভেকধারী
কিছু মানুষের এই আমোগগেঁড়ের মত উচ্ছ্বাস সব থেকে বেশী। তারা একবারও ভেবে দেখে না, কবি যে কালখন্ডের মধ্যে বা রাষ্ট্র কাঠামোর
মধ্যে বাস করেন সেটি প্রতিকূল হয়ে বাধ্য। It
is bound to be hostile…। রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভা-সদৃশ পরিস্থিতি আসলে এক ফাঁদ। বেশ কিছু সাপ আছে, যারা সন্তানের জন্ম
দেবার পর নিজের বাচ্চাকে নিজেই খেয়ে ফেলে। রাষ্ট্র বা সমাজ আসলে এক কবির সামনে
সেই সাপের সমান। ডিমকে বেড় দিয়ে , উষ্ণতা দিয়ে সমাজ
বা রাষ্ট্র অনেক সময়ই সাপের মতো অনুকূল ভূমিকা পালন করার ক্যামোফ্লেজ করে। কিন্তু কিছুটা সময় পরে সে তার কালো হাত পেতে দাঁড়ায়। তাই একজন প্রথম শ্রেণির কবির ক্ষেত্রে
নীরবতা বলে কিছু হয় না। কারণ প্রথম শ্রেণির একজন কবিকে সব
সময়ই ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে ছুটে চলতে হয়। তার কোনও কমফোর্ট জোন থাকতে পারে না।
কিন্তু এই ক্ষত-বিক্ষত হওয়াও কি সব সময় বাইরের কোনও
প্রনোদনার উপর নির্ভরশীল?
এর উওর, না এবং না। বাইরের সব ‘ফ্যাক্টর’ অতিক্রম করতেই হয়
কবিকে। কিন্তু নিজের সঙ্গে নিজের একটা বোঝাপড়াও থেকে যায় তার কবিতা লেখার শেষ দিন
পর্যন্ত। কারণ যে কমফোর্ট জোনের কথা বলা হচ্ছে, সেটি অনেক সময় তার প্রকৌশলজনিত
কারণের ঘনিয়ে উঠতে পারে। নিজেকে অনবরত ভাংচুর ও নতুন পথের সন্ধান করাও একজন প্রথম
শ্রেণির কবির খুব বড় একটা কাজ। যে কোনও প্রথম শ্রেণির কবির সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে
তাই গা শিউরে ওঠে। যেখানে তাকে সব থেকে প্রেডিক্টটেবল বলে মনে হচ্ছে সেখান থেকেই
তার সব থেকে বড় বাঁক শুরু হয়। সে পথ রহস্যময়। অজানা, অচেনা। সেই পথে চলা শুরু করতে
গিয়ে কবি তার নীরবতা ভাঙেন। নীরবতা মানে এখানে এক ধরণের
স্ট্যাটিক অবস্থানকে বোঝায়। সেই ণীরবতা ভাঙার চিৎকার সব সময় ফর্মে বা কনটেন্টে
রিফ্লেক্টেড হয় না। এ যেন অনেকটা মহাকাশে
মহাশূণ্যে মহাকালের মাঝখানে ভাসমান এক নভোশ্চরের চিৎকার। নিজের সঙ্গে নিজের
কথোপকথন। কেউ শুনবে না হয়তো কোনও দিন সেই চিৎকার। কারুর কাছে পৌঁছানোর কোনও
অভিপ্রায়ও নেই তার। শুধু নিজেকে আঁচড়ে-কামড়ে নীরব চিৎকারের মধ্যে দিয়ে এক
পরিনামহীন ইনফিনিটির দিকে ছুটে যাওয়া।
এবার অন্য এক সূত্রে একে ডিসাইফার করা যাক।
কবির নীরবতা, আগেই বলা হয়েছে, আমার কাছে আপেক্ষিক একটি
শব্দগুচ্ছ। বহুরৈখিক। রিলেটিভ একটা টার্ম। কবিকে সমাজ এক
বিন্দুও স্পেস ছেড়ে দেয় না। বরং অনবরত তার স্পেস কমে আসতে থাকে। গলা টিপে ধরতে চায়
রাষ্ট্র। অনেক সময়েই তার আঁচ এসে পড়ে কবির গায়ে। সেই আগুনের আঁচ সব থেকে প্রথমে
এসে পড়ে তার লেখায়। আমার বিশ্বাস, একজন সৎ ও প্রথম শ্রেণির কবি তার কবিতা দিয়েই
সেই ইনফার্ণোকে ধরে রাখতে চান। জীবনানন্দের ভারবি সংস্করণের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে
থাকা যে অসংখ্য কবিতা, সে দিকে তাকালেই বোঝা যায় তাঁকেও অনিবার্যভাবেই আলোড়িত
করেছিল সমকাল। এমনকি যে কবিকে আমাদের মনে হয়, সঙ্গত কারণেই মনে হয় নীরবতার কবি,
তাঁর কবিতাতেও অনেক সময়ে তিনি উচ্চকিত। সরাসরি কমিউনিকেট করবার চেষ্টাও করছেন। যে
ফর্ম একান্তভাবেই জীবনানন্দীয় সেই ফর্ম থেকে বেশ কিছুটা সরে এসে তিনি ধরে রাখতে
চাইছেন বাংলার ধ্বস্ত রূপকে, দুটি বিশ্বযুদ্ধের মারি ও রক্তপাতকে। এখানে তাঁর
কবিতার কনটেন্ট এতটাই প্রভাবিত করছে তাঁর ফর্মকে যে আমাদের স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া আর
কোনও উপায় থাকে না।
কিন্তু এখানেই সব সম্ভাব্য পথের ইতি নয়। আরেকটি প্রবণতাও
দেখা গেছে বারবার। অনেক সময়ে কবি নিজেই যাজকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পড়েন। নিজের
লেখার থেকে সরে গিয়ে, ঘুমরোগের মাছির
কামড়ে তিনি ক্রমশ এক বিকলনের শিকার হয়ে পড়েন। এই সময়ে ছিদ্রপথে তার মননে প্রবেশ
করে ওই জীবনানন্দ কথিত তৃতীয় শ্রেণির কবিদের মত স্থূল ‘উদ্বোধন’ প্রবণতা। যেহেতু
তিনি এক সময়ে কবিতার প্রতি নিবিষ্ট ছিলেন ও কবিতাকে ‘দাঁড়’ করিয়ে দেবার মত এক
ক্র্যাফটসম্যানশিপ তার আয়ত্বে তাই তিনি লিখে যান। নিশ্চয়ই লেখেন কবিতার পর কবিতা।
কিন্তু সে সব লেখার মধ্যে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায় তার যাজকবৃত্তি।
এর পরের স্তরটিই হল রাষ্ট্র-ক্ষমতা ও রাজনৈতীক ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে কবির
নীরবতা ভঙ্গ করার প্রবণতা। কবি যতক্ষণ একজন অসীম মেধা ও ক্রান্তদর্শী মানুষের মত
মানবতার পক্ষে কথা বলেন ততক্ষণ কোনও সমস্যা ঘনায় না। সমস্যা তীব্র হয়ে যখন তিনি
নিজেকে পণ্য করে তুলে রাজনৈতীক ক্ষমতার দিকে হাত বাড়ান। এবং বলাই বাহুল্য সেই
ক্ষমতা ও রাজার এঁটো চেটে খাবার জন্য তিনি নিজের অবস্থানকে অনবরত পালটে পালটে
চলেন। এখানে প্রশ্ন উঠতেই পারে, মানুষের অবস্থান কি অপরিবর্তনীয়? বিশেষ করে
রাজনৈতীক অবস্থান?
রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প। কিন্তু কবি যে চেতনাকে লালন করতে
চান, যে স্ফূরণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টির গভীর
থেকে গভীরতর স্তরে পৌঁছাতে চান সেখানে এই সম্ভাবনার কোনও স্থান নেই। একজন প্রথম
শ্রেণির কবি আসলে নিজেকে নিজেই ক্ষমতা প্রদাণ করে। তাঁর হয়ে ওঠার ইতিহাস আসলে
স্ব-ক্ষমতায়নের ইতিহাস। কোনও বাহ্যিক শক্তি তাকে ক্ষমতা প্রদাণ করতে পারে না।নিজের
প্রতিটি সার্থক লেখার মধ্য দিয়েই একজন কবি ক্ষমতা অর্জণ করেন। তাঁর লেখাগুলিই তাঁর
ক্ষমতার স্তম্ভ। এবং এই সহজ কথাটাই ক্ষমতা-দখলের মানসীকতা নিয়ে নীরবতা ভাঙা কবি
দ্রুত ভুলে যান। তাকে গ্রাস করে নির্বাচিত মুখরতা ও নির্বাচিত মৌনতার শিল্প। তিনি
হয়ে ওঠেন ধুরন্ধর এক দালাল বা ট্রেচার।
একজন ব্যাক্তি মানুষের আমরণ এক অবস্থানে থিতু থাকতেই হবে,
এই ধরণের কোনোও মৌলবাদী ধারণায় আমার বিশ্বাস নেই। অনিবার্য হলে কবি তার নীরবতা
ভাঙতেই পারেন। কবিতাও লিখতে পারেন। উচ্চকিত বা কিছুটা টাইম-সার্ভিং কবিতা হলেও তা
তে সামগ্রীকভাবে কবিতার ইতিহাস খুব বেশী আক্রান্ত হয় না বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু
ক্ষমতার লালা-মাখা থুতু-মাখা অক্টোপাসের বাহু থেকে তাকে দূরত্ব বজায় রাখতেই হবে।
শুধু তাই নয়, একজন কবিতা লেখক, তার নিজের কাছে অনিবার্য
মনে হলে সরাসরি রাজনৈতীক বা রাষ্ট্রনৈতীক ক্ষমতা দখলের দিকেও চলে যেতে পারেন। তিনি অ্যনার্কিজমের ঘোরতর প্রবক্তা হলেও আমার কাছে বিষয়টা আরেকটি অ্যনার্কিষ্টের
জন্ম ছাড়া আর কিছুই হবে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সব থেকে আগে তাকে কবিতার উষ্ণীষ খুলে
রাখতেই হবে। আংশিক অন্ধত্ব নিয়ে ও নিজের চোখে নিজেই ঠুলি পরিয়ে কবিতার কাছাকাছি থাকা যায় না।
যতক্ষণ তুমি কবিতার ততক্ষণ তোমার চিৎকারও কবিতার। তোমার নীরবতা ভেঙ্গে ‘সামাজীক’ চিৎকার ভুল হতে পারে। তোমার চিৎকার থেকে সরে এসে নীরবতা ভুল হতে পারে। সময় তোমার দিকে একই ভাবে আঙুল তুলতে পারে, বলতে পারে, তোমার যখন সরব হবার কথা ছিল তুমি
তখন নীরব থেকেছ কিংবা তোমার যখন নীরব থাকা উচিত ছিল তখন তুমি ভুল ভাবে সরব হয়েছ। কিন্তু যে মুহুর্ত থেকে তুমি কবিতাকে সামনে রেখে গুপ্তচরের মত ক্ষমতার অলিন্দে
ঘোরা শুরু করলে, যে মুহুর্ত থেকে তুমি
ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য তোমার অবস্থানকে পালটে পালটে নিতে শুরু করলে সে মুহুর্ত থেকে
তুমি একজন শাইলকের থেকেও নিকৃষ্ট। সার্থক কবিতা গায়ে যে সুরক্ষা-কবচ নিয়ে জন্মায়, তোমার কবিতা এর পর থেকে তার আর সন্ধান পাবে না। যতই ভাববাদী মনে হোক না কেন, আমার বিশ্বাসে আমি অটল থাকছি।
‘কবির নীরবতা’র থেকে তুলনায় অনেক একমাত্রিক,
কম আপেক্ষিক ও মৌল-লক্ষণযুক্ত শব্দগুচ্ছ ‘নীরবতার কবি।’ আমার কাছে নীরবতার
কবি আসলে বনের মধ্যে শুয়ে থাকা শান্ত, ঝরাপাতা-ভরা পথ। যে পথ অনেক পাহাড়ী ঝোরা, বনবস্তির পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে মিলিয়ে
গেছে খুব উঁচু কোনও এক প্যাগোডার দিকে। সেই প্যাগোডার থেকে ভেসে আসা মন্ত্রের
মৃদু-অনুচ্চ স্বর ভেসে বেড়ায়
পাহাডের ঢালে, মানুষের মাথার ওপরে, বুকের
কাছেও। পবিত্রতা ও বিষন্নতা একই মায়ের পেটে জন্মানো দুই ভাই। তারা হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ায় সেই
পথে।
জেন সাধকেরা সেই পথের পথিক ছিলেন। সেই পথে হেঁটে যেতে দেখি লালনকে, রবীন্দ্রনাথকে। চর্যাপদের পদকর্তারাও তো সেই পথেই হেঁটে বেড়াতেন নাগরীক জীবন থেকে দূরে। এক সুউচ্চ দর্শণ ও জীবনবোধ ছাড়া এই পথে অবিচল থাকা যায় না। কবিতার সামান্য পাঠকমাত্রই জানেন যে আমার এই বলা কথাগুলির মধ্যে তেমন কোনও নতুনত্ব
নেই। কিন্তু আমি অন্য একটি সম্ভবনার দিকেও তাকাতে চাই। নীরবতার কবিরা কি কখনই তাদের সুউচ্চ-প্রাচীর ঘেরা কবিতার জগত থেকে বেরিয়েও
আসেন না? রবীন্দ্রনাথ সহ এই পথের আরও অনেক কবিই কি আক্ষরিক অর্থেই
তাঁদের নীরবতা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেননি কখনও কখনও?
বেরিয়ে এসেছেন, অনিবার্য বলেই তাঁরা ভঙ্গ করেছেন তাঁদের নীরবতা। কিন্তু কখনও তাঁরা তাদের সৃষ্টিকে হাতিয়ার করে তাৎক্ষনিক লাভালাভের কুটিল জগতে
প্রবেশ করেননি। আর লোকশিক্ষার কারণে দর্শণের ছায়াপাত ঘটেনি তাঁদের কবিতায়; সেখানে দর্শণ এসেছে জীবনবোধের এক স্বাভাবিক
প্রকাশের পথ ধরেই।
এই লেখাটি শেষ করব আমার প্রিয় একটি কবিতা দিয়ে,
‘সন্ধ্যার লোকাল ট্রেন।
অন্ধ ভিক্ষু লাঠি দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ওঠে,
লাঠি
দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে নামে,
লাঠি দিয়ে
ছুঁয়ে ছঁয়ে কামরা বদল করে, ভিক্ষা চায়।
লাঠির প্রকৃত শক্তি লেঠেল জানে না, অন্ধ জানে।‘
কবিতাটির লেখক কবি সুজিত সরকার। সুজিতের কবিতা যারা পড়েছেন তারা সকলেই
একমত হবেন যে তিনি মুখ্যত নীরবতারই কবি।তাঁর
কাব্যকৃতিতে উচ্চকিত স্বরের কোনও স্থান নেই। কিন্ত এই কবিতাটি তো হাজার মুখরতা পরাস্ত
করে দেয় এক নিমেষে। এই কবিতাটিতে আমি ছেয়ে থাকতে দেখি এক আশ্চর্য রাজনৈতীক স্বর। অথচ কবিতাটি শেষ পর্যন্ত কবিতাই হয়ে ওঠে। বারবার এটির দিকে আলো ফেললে পৃথক পৃথক
বর্ণের বিচ্ছুরণ চোখে পড়ে।
যেমন এই লেখাটি লিখতে গিয়েও আরেকবার কবিতাটি অন্য ভাবে ধরা দিল
আমার কাছে।
ওই অন্ধ ভিক্ষু আমার কাছে জীবনানন্দ দাশ কথিত সেই প্রথম শ্রেণির
কবি ছাড়া আর কেউ নন। একজন কবির জীবনও আসলে ওই ভিক্ষুকেরই মত। সারা জীবন তাঁর লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে অন্ধকারে পথ চিনে নেওয়া। এই ভাবেই হাজার হাজার চক্ষুস্মানের থেকেও বেশী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে সে। এই ক্ষমতা তার মহাকাশ সমান উচ্চ। অসীম।
একজন প্রথম শ্রেণির কবি তাই তাঁর নীরবতার বিষয়ে সচেতন। তিনি জানেন, তার নীরবতাও এক ধরণের
শক্তির প্রকাশ।
আর যখন তিনি নীরবতা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন তখন তিনি আরও বেশী সচেতন। কারণ তখনও তিনি জানেন এই মুখরতার প্রতিও তাঁকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে। স্বার্থসিদ্ধির নিচু বাস্তবতার কারণে নয়, তাঁকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে তাঁর চেতনার স্ফূরণের মধ্য দিয়ে অর্জিত
জ্ঞান ও শক্তির প্রতি।
এই শক্তি তাঁর সোপার্জিত...
চমৎকার। সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDelete