ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি
কবি, কবিতা ও নৈঃশব্দ্য
১।
কবি
নির্জন শেফালী আর একটু
দূরের
ঈষৎ সবুজ ওই তারাটি
বস্তুত একই তরঙ্গের
অংশমাত্র।
প্রতিদিন তাদেরকে এইখানে
যে ডেকে পাঠায়
সেই গাছটির নাম রাত্রি।
তুমি ধীরে ধীরে তার
প্রতিটি শাখাই ছুঁয়ে যাচ্ছ
বালকের মতো হেলা ভ’রে…
শিশিরে, নৈঃশব্দ্যে...
২।
কবিতা
যখন লেখালেখি
শুরু করি, সেই একদম প্রথম দিকের দিনগুলিতে না
হলেও, কিছু দিনের মধ্যে বুঝে নেবার ভান করেছিলাম, কী লিখব, কেন লিখব। সেই ভান বহুদিন ছিল। তারপর
একদিন সেগুলিকেই বিশ্বাস করতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম এমন লেখা লিখব যাতে লেখাগুলি
থেকে নৈঃশব্দ্য উৎসারিত হয়ে জায়গা করে নেবে শব্দহীনতার, "সাধারণ হৃদয়ের"। ভেবেছিলাম প্রতি-আক্রমণে যাবো শব্দের পবিত্রতা
দিয়ে। অর্থাৎ প্রতিটি চিত্রকল্প, প্রতিটি কবিতা, হবে এমন এক শব্দময় বিচ্ছিন্নতা যা প্রকৃতপ্রস্তাবে হয়ে উঠবে এক অপরিসীম
বিদ্রূপ, প্রচলিত আরোপিত মডার্নিটি-র বিরুদ্ধে। এক
স্বনির্বাচিত স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যেতে চেয়েছিলাম আমি বা আমরা অনেকেই, আমাদের সময়কার সমান্তরাল চিন্তাভাবনা থেকে। ভেবেছিলাম, এই-ই দ্রোহ। বন্ধু অনির্বাণকে ধার করে বলি, ভেবেছিলাম
"দুধ বেচবো, পাহাড়তলিতে"। এই ফ্যাব্রিকেটেড কোকুন
যে কত বড় ব্যর্থতা, কত ডিলিউশনাল তা আজ নিজেই টের পেলাম।
পরিবেশ আজো যে প্রভাবিত করে আমাকে! শুনেছি জেন সন্ন্যাসীদের এমন কিছু সেক্ট আছে,
যারা শব-সাধনা করেন। শব-সাধনা কথাটা অবশ্য এই ক্ষেত্রে খাটে না,
কারণ তারা পচনশীল, গলিত শবের উপর বসে
নিজেকে পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে একাগ্র করবার অনুশীলন করেন। কিন্তু একজন
লেখক-কবি কীভাবে করবেন এই "শব-সাধনা"? বা তাও
কী সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে কীভাবে বলি আমার কবিতাকে
হয়ে উঠতে? কোন ভাষায় আজ লিখব? ভিতরে
ভিতরে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। স্তব্ধতা স্থির, অসাড়। যে
নৈঃশব্দ্য চরম লক্ষ্য বলে জানতাম, তা কিন্তু ঝর্ণার মত,
উপচে পড়ে, লেখক পাঠকের দূরত্বকেও ভাসায়।
জল থৈ থৈ করে। আফিসার মৃত নীল ঠোঁট দুটিকে আজ সকালেও মনে হচ্ছিল এক মৃত-দেশের 'পর ফুটে থাকা লিলি ফুল, ফেসবুকে স্টেটাস
আপডেটও করেছিলাম, "April is the cruelest month, breeding/ lilacs out
of the dead land..." কিন্তু তারপরও কী ওই মৃত ঠোঁট দুটির
কানের কাছে তীব্র ধারাবাহিক চীৎকার আকাশ ফাটিয়ে দিচ্ছে না? আজ আফিসার মৃত ঠোঁটের চীৎকার, আমাদের সমস্ত
লেখালেখি তার মেথডলজি, লক্ষ্য, সবকিছুই
কী ভাসিয়ে দিচ্ছে না, যেরকম মৃত সন্তানকে মা ভাসিয়ে দেয়
জলে?
আফিসা আমার
মেয়ে নয়, আফিসা আমার মা। আমি তাঁর মৃত সন্তান।
ফেসবুকের
স্ট্যাটাস আপডেটঃ ১৪ই এপ্রিল ২০১৮
৩। নৈঃশব্দ্য
অর্থহীনতা
থেকে নিরর্থের দিকে এই যাত্রাপথ; সুপারি গাছের গায়ে লেগে থাকা পার্থিব শামুকের মতো অন্ধকার ক্রমে আরো
নীরব হয়েছে। ডায়ালগ না থাকলেও মনোলগ ছিল এই তো সেদিনও। এই তো সেদিনও রুমালের মত এক
টুকরো মেঘ মুছে দিত চাঁদের চোখের জল আর ছাদের উপর ঝরে পড়তো নারকেল ফুলের নৈশব্দ।
ছাদের উপর থেকে দেখা যেত বহুদূর। ছোট ছোট প্রতিটি আলোর পাশেই আমি চোখ বন্ধ করে
দেখতে পেতাম একটি মুখ। মনে হত আমাকে আরো ভাল হতে হবে। বন্ধু, কমরেড, প্রেমিক। আইভান তুর্গেনিভ এসেছিলেন ‘সোভিয়েৎ দেশ’ থেকে, সেই
অমরত্বের দিনগুলিতে। আমরাও কলেজস্ট্রিট, কফিহাউস ছাড়িয়ে
চলে গেছি ক্যানিং, মাতলা, চূর্ণীর
দিকে। যেন ছবিতে গল্পের দেশ...পাখি পাখি ভোরবেলা, অন্ধ
বাউলের গান নিয়ে জলপাইগুড়ি, মূর্তির দিকে...বহুদূর অন্তত
বছর ত্রিশ পথ এইখান থেকে। যে-কোনো কিছুর ইতিহাসই প্রাচীন, দেয়ালে ঝোলানো হরিণের সিঙের মতন।
কিন্তু আজ যেন
নীরবতাই নৈশব্দ রচনা করেছে। মোক্ষহীনতার এই মোক্ষে একজন কবির কবিতাকেই কী দাঁড়াতে
হবে নৈশব্দের বিপক্ষে? কার কাছেই বা সে দেখাবে সেই ফ্লুরোসেন্ট রক্ত যা তার চীৎকারে বেরিয়ে
এসেছে কিছুটা মিউকাসের সঙ্গে। একটা বাতাসহীন সামাজিক ভ্যাক্যুয়ামের ভিতরে দাঁড়িয়েই
তো তাঁর এই এই চীৎকার ।
বাংলাভাষার
একজন কবিও যদি আবার “আজি হতে শতবর্ষ পরে...” রিরাইট করেন সেই
ব্যভিচার কী তাঁর অন্তহীন অজ্ঞতার মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে না? বস্তুত কবি যদি সমাজ বহির্ভূত কোনো এন্টিটি নাও হয়ে থাকেন, তবুও মহাকালের, আজকের কবিকে মনে রাখতে বয়েই
গেছে। একটা মহৎ কিম্বদন্তী জন্মাতেও যে সময়ের দরকার, ততটুকু
সময়ও কী আর হাতে আছে আমাদের? বৈশ্বিক উষ্ণায়ন (আঞ্চলিক ‘উন্নয়নের’ কথা ইচ্ছে করেই আর এখানে বলছি না)
হয়ত তারও আগে সুন্দরবনের ব-দ্বীপগুলি এবং কলকাতার একটি বৃহদাংশকে বঙ্গদেশীয়
উপসাগরটিতে একই সঙ্গে চান করাবে, নগ্ন। যে শহরটিতে বসে
আমি এই লেখাটি টাইপ করছি, সম্ভবত সেই ভূখণ্ডটির উপর দিয়ে
বয়ে যাবে ট্যালটেলে উষ্ণ একটি স্যুপ।
কবিতায় “শ্বসিত বস্তু বা ‘অরগানিক’ অস্তিত্বের চিহ্ন” উপস্থিত না থাকলেও কবিতার মৃত্যু হয়, হতে
পারে। আর মৃত্যুর পরে যে ন্যারেটিভ তাকেই তো একইসঙ্গে নীরবতা ও নৈ:শব্দ বলে মনে হয়
আজ।
No comments:
Post a Comment