Sunday, June 3, 2018

নীরবতা জায়মান, নীরবতা অনন্তের : সুবীর সরকার

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি





                      নীরবতা জায়মান, নীরবতা অনন্তের




‘মরণের পরপারে বড় অন্ধকার
এই সব আলো প্রেম ও নির্জনতার মতো’।__জীবনানন্দ দাস

১।
কবির নীরবতা।নীরবতার কবি।আসলে নীরবতাকে ছড়িয়ে দিতে দিতে ভেতরের অন্তর্গত এক নীরবতাকেই হয়তো মান্যতা দিয়ে ফেলা হয়।নীরবতার সীমা ও পরিসীমার ফোঁকড়ে আদ্যন্ত এক নীরবতাই বুঝি জায়মান হয়ে যেতে থাকে।কবির ভেতর অনন্তের এক নীরবতা থাকে।আবার সামাজিক ঘটনাক্রমের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় কবি নীরবতাতেই আস্থা রাখেন।আসলে কবির নিজস্ব নীরবতা আর সামাজিক কালখণ্ডে জেগে থাকা নীরবতা একধরণের ভ্রম তৈরী করে।ভ্রম থেকে আসে বিভ্রম।আর যথারীতি সেসব বিভ্রমের ওপর দিয়ে উড়তে থাকে ফড়িং,প্রজাপতি কিংবা নীরবতা।অনেক নদীর জল।রতিকান্ত দেউনিয়ার ভরা হাটে নাচতে থাকা;নেচে নেচে প্রাচীন দৃশ্যটুকরোর মতন সমবেত গানগুলিকে গাইতে গাইতে ভরা হাটে একধরণের আস্ত নীরবতার জন্ম হতে থাকে।আর কবি ঝুঁকে পড়েন,কবিকে ঝুঁকে পড়তেই হয় এই আবহমানের নীরবতার ওপরে।কবি কিন্তু লুকিয়ে রাখেন নিজেকে।আর লুকিয়ে থাকাটাকে আবশ্যিক মনে করলেও কবি তার সামগ্রিক নীরবতাকে বন্দনাগানের জরুরীতম অংশে যুক্ত করে দিতে থাকেন।
২।
সাপের ফণার মাথায় নীরবতাকে তুলে দেন কবি।চারপাশের ঘটনাক্রমকে দেখতে দেখতে একধরণের নিরাশক্তি তাকে পীড়িত করে।কবি তখন তার মজ্জাগত নীরবতার খোলস ছেড়ে নীরবতাকে দ্রোহে রুপান্তরিত করতে থাকেন।রাজপথ,গলিগুলি,হাটবন্দরে জনতার সাথে মিশে গিয়ে প্রতিবাদের এক মহামিছিল বিনির্মিত করতে থাকেন।বিশ্বইতিহাস এই দেখিয়েছে আমাদের যে,কবির তো নীরবতা থাকেই;কিন্তু সময়ের ডাক অস্বীকার করতে না পেরে কবি কিন্তু গনমানুষের উচ্চারনের সাথে নিবিড় হয়ে লিপ্ত থেকেছেন।আবার অনেক কবি,বিদ্বজ্জন কিন্তু কবির নীরবতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।দেশকালসময়ের সংকট তাকে ছোঁয় না,ছুঁতে পারে না!সে অদ্ভূত নিরাশক্তি নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত খোলসে নিকে নিরাপদ রাখেন,সরিয়ে রাখেন।কেননা,যদি রাষ্ট্র আর ক্ষমতার সিংহাসন থেকে তাকে সরে যেতে হয়!শাষককে তুষ্ট করতে গিয়ে কবি নিজেকে ভুলে যেতে থাকেন।তিনি অদ্ভূত নিরাশক্তি নিয়ে পরে নিতে থাকেন চিত্রবিচিত্র মুখোশ।কবির নীরবতা আর নীরবতার কবি তখন বিকেলমেঘের মতন মিশে যেতে থাকে আকাশের ব্যপ্ততায়।
৩।
বিদ্রুপগুচ্ছ উড়ে আসছে নীরবতার কবির দিকে।কবিদের দিকে।কবি এসবে যদিও ভাবিত নন।কেননা ক্ষমতা তাকে সুরক্ষা দিয়েছে।উতসবমুখরতা দিয়েছে।অন্তহীন অসার সব মোসাহেব দিয়েছে।তাই বিদ্রুপগুচ্ছকে গুরুত্ব না দিয়েও কবি কিন্তু তার ভেতরের গ্লানিকে পুরোপুরি ঢাকতেও পারছেন না!এ সত্য আবহমানের।চিরকালীন।কবি তার নীরবতাকে নুতন কোন জনপদের পথে পথে হেঁটে যাওয়া চিরসত্যের পাশে বসিয়ে দিতে থাকেন।আর নীরবতাকে অতিকায় এক খ্যাপা ষাঁড়ের ছুটে যাওয়া বলে পুনরায় ভ্রম মনে হতেও পারে।চিরদিনের না ফুরোন গল্পগুলিকে তখন অনেক অনেক নদীর জল বলে মনে হয়।গঞ্জহাটের ধুলোয় তখন কবিরাজের কেশর ফোলানো ঘোড়ার ছুটে চলা।যত কিছুই হোক,হতে থাকুক কবির নীরবতা আর নীরবতার কবি সব মিলিয়ে আস্ত আস্ত গানের মতন এক কুহক বুঝি!
নীরবতার কবি,কবির নীরবতা নিয়ে এইভাবে আবহমানের গানগুলি আমাদের বিস্তৃত চরাচরে সুরতালয়হীন নেমে আসতে থাকে।





No comments:

Post a Comment