Tuesday, June 5, 2018

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে





চিঠি— ৬


গভীর নির্জনতায় যার বাস, তার কাছেই ধরা দেয় গভীর কোনো বিষয়ের সুত্র
                                                                           রোম
                                                                 ডিসেম্বর ২৩, ১৯০৩                                                   

প্রিয় কাপুস,
চারদিকে ছুটির আমেজ, বড়দিনের উৎসবমুখর প্রস্তুতি, এমন সময় তোমার একাকীত্ব অন্যসময়ের চেয়ে আরো প্রবল হয়ে উঠুক তা হতে দেয়া যায় না। তাই তোমাকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে এই চিঠি। যদি দেখ তোমার নিঃসঙ্গতা গভীরে শেকড় ছড়াচ্ছে, তাকে মেনে নিও খুশি মনে। নিজেকে প্রশ্ন করো, যে একাকীত্বের শেকড় নেই তাকে কি নিঃসঙ্গতা বলা যায়? এর ওজন এত বেশি যে ভার সবাই বইতে পারে না। এ বড় কঠিন কাজ। নিজের একলা প্রহরে যেকোনো মানুষেরই চাই অন্যের সান্নিধ্য, সামাজিকতার যেকোনো অনুষঙ্গ সে আঁকড়ে ধরে খড়কুটোর মতো, মানুষের সঙ্গে ওঠা-বসার একটু সুযোগ পেলে, হোক না তা ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, তাতেই সে বর্তে যায়; একটু মেলামেশা, সমঝোতার জন্য আকুলতা বাড়ে। হয়তো এ সময় একাকীত্ব আরো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ যেন অনেকটা নিঃসঙ্গ কিশোরের বেদনার্ত বেড়ে ওঠা, কিংবা বসন্তের প্রথম দিনগুলোর মতো দুঃসহ। তোমাকে যেন তা বিভ্রান্ত না করে। সবকিছুর পরও নিঃসঙ্গতা, অন্তর্নিহিত গভীর একাকীত্বই প্রয়োজন তোমার। আর প্রস্তুতি নাও, অন্তর্যাত্রার। যেখানে তুমি হেঁটে যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, একাকী। তোমাকে এই হাঁটার জন্য তৈরি হতে হবে। যেমনটা হাঁটতে সেই ছেলেবেলায়—  নীরবে, একাকী বসে দেখতে চারপাশের ব্যস্ততা, মানুষের দ্রুত হাঁটাচলা, তাদের এই আসা-যাওয়ার উদ্বেগ দেখে মনে হতো খুব জরুরী কাজে তারা ছুটে চলেছেন। যদিও এসবের কিছুই বোধগম্য ছিল না তোমার কাছে।
       
বড় হয়ে বুঝতে পারলে তাদের সব কর্মকাণ্ডই জরাজীর্ণ; অর্থহীন তাদের জীবিকা, অসাড়তায় ভরপুর; প্রকৃত জীবনের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। তাহলে তো বলতে হয়— শিশুর চোখ দিয়ে দেখাই ভালো, এইসব জাগতিক দৈনন্দিন জীবনযাপন, অপরিচিত পৃথিবী। নির্জনতায় সবকিছুকে এই দৃষ্টিতে দেখাই হলো তোমার কাজ, আর এভাবেই বাড়বে তোমার মর্যাদা। আত্মরক্ষা ও লোকজনের অবজ্ঞা থেকে বাঁচতে শিশুতোষ বিজ্ঞতার আড়ালে দুনিয়াদারি না বোঝা থেকে কেন সরে আসবে বলো? এই না বোঝা এক অর্থে নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ও আড়ালে রাখার কৌশল। আর আত্মরক্ষা ও লোকনিন্দা বা অবজ্ঞা হলো এমন কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা যা থেকে তুমি আলাদা থাকতে চাও। 
      
দেখো কাপুস, মনের ভেতরের যে জগৎ তাকে নিয়ে ভাবো, গুরুত্ব দাও, মন যা শুনতে চায়— শোনাও, যা বলতে চায়— বলো। স্মৃতি খুঁড়ে তুলে আনো শৈশবের দিন। ভাব প্রত্যাশা ও ভবিষ্যতের কথা। তোমার মধ্যে যেসব অনুভূতি জেগে ওঠে তার প্রতি মনোযোগী হও। নিজের উপলব্ধিকে গুরুত্ব দাও সবকিছুর ওপরে। তোমার মনে যা কিছু ঘটছে তা তোমার সর্বোচ্চ ভালোবাসার ধন। এসব নিয়েই তোমাকে থাকতে হবে, ভাবতে হবে। এই তোমার পৃথিবী। অন্যদের নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় ও শক্তির অপচয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর অন্যদের নিয়ে ভাবতেই হবে এমনতো কোনো কথা নেই! জানি অনেক কঠিন পেশা বেছে নিয়েছ। নিজস্ব চিন্তার পরিপন্থী অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। আমি আগাম দেখতে পাচ্ছি সেজন্য দুঃখ পাচ্ছ তুমি, জানতাম এমই হবে, এমনটাই হওয়ার কথা। তোমাকে সান্তনা দেবে এমন কিছু বলতে পারছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি, পৃথিবীর সব পেশা একই রকম। যা দেয়, নেয় তার চেয়ে বেশি। ব্যক্তির কাছে তার অনেক প্রত্যাশা, বৈরিভাবাপন্ন পরিবেশে, একঘেয়ে, নীরস কর্তব্যপালনে যাদের আগ্রহ নেই তাদের প্রতি নির্মম। যে পরিস্থিতির মধ্যে তুমি আছ তা সংষ্কার, রীতিনীতি, প্রথা, ভুল ধারণা এরকম সামাজিক বোঝার চেয়ে জটিল নয়। কেউ যদি এর চেয়ে ভালো অবস্থান কিংবা তুলনামূলক স্বাধীনতার প্রলোভন দেখায়, জেনো এ স্বাধীনতা কিছুই নয়। সত্যিকার স্বাধীনতার বাস জীবনের গভীর বিস্তৃতির মধ্যে, সব গুরুত্বপূর্ণ বস্তুর সঙ্গেই তার সম্পর্ক। গভীর নির্জনতায় যার বাস, তার কাছেই ধরা দেয় গভীর কোনো বিষয়ের সূত্র। ভোরে সূর্যোদয়ের আগে যখন সে হাঁটতে বের হয়, সন্ধ্যায় তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, অনুভব করে সবকিছু, যা ঘটছে চারপাশে; এই পুরো পরিস্থিতিই তার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে। যেন মৃত কোনো মানুষের হাত থেকে টুপ করে খসে পড়েছে তা; যদিও সে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃত জীবনের মাঝেই।
     
প্রিয় কাপুস, এখন তোমাকে চৌকস পেশাদার ব্যক্তির মতো অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে। যেকোনো প্রতিষ্ঠিত পেশায় গেলেও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবে তুমি। হ্যাঁ, যেকোনো পেশাগত অবস্থান থেকে যদি মানুষের সঙ্গে মেশার সহজ উপায় খুঁজতে, তাহলেও বন্ধনের শেকল তোমার মনে থেকেই যেত। এ শেকল ভাঙা সহজ নয়। এমনটাই ঘটছে সবক্ষেত্রে। কিন্তু এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া বা দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। মানুষের সঙ্গে যদি মিশতে নাও পার, কাছাকাছি থাক। অথবা বিকল্প হিসেবে বেছে নিতে পারো বস্তুকে, প্রকৃতিকে। একাত্ম হও এদের সঙ্গে। মানুষের মতো এই প্রকৃতি, বস্তুরা তোমার সঙ্গে  বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, তোমাকে ছেড়ে যাবে না কখনো। জনপদ ও গাছপালার মধ্য দিয়ে যে বাতাস বয়ে যায় তা চিরকালীন, বস্তু ও প্রাণীদের জগতে সবকিছুই ঘটমান, সম্ভাবনাময়; এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারো তুমি। 
     
আর শিশুকাল একই রকম, এই সময়ের শিশুরা তেমনই যেমনটা তুমি ছিলে তোমার শৈশবে। একই রকম বিষণ্ণতা ও আনন্দে কাটছে তাদের দিন। নিজের শৈশবের কথা ভাবো, মনে হবে তুমিও তাদেরই একজন। এখনো তাদের মধ্যেই আছ। আর এ জীবন ছেড়ে বড় হওয়ার কোনো মানেই হয় না। কারণ  সমাজে বয়স্কদের কোনো মূল্য নেই। তাদের মর্যাদাও গুরুত্বহীন। 
    
তবে যদি শিশুকালের কথা ভাবতে ভয় পাও; এর সারল্য ও মৌনতা তোমার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়ে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে তুমি আর ধর্মে বিশ্বাসী নও, বিশ্বাসী নও স্রষ্টার অস্তিত্বে। অথচ তিনি আছেন সবকিছুতেই। নিজেকে প্রশ্ন করো, ভেতরের স্রষ্টাকে তুমি হারিয়ে ফেলেছ কিনা। অথবা এটাই কী বড় সত্য যে তুমি তাকে কখনোই ধারণ করতে পারোনি। এমন কি হয়েছে কখনো? তোমার কি মনে হয় কোনো শিশু তাকে ধারণ করতে পেরেছে কখনো অথবা কোনো শিশুর পক্ষে আদৌ তাকে ধারণ করা সম্ভব?  প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরা অনেক সাধনার পর তাকে ধারণ করতে পারলেও এই ভারে শেষ পর্যন্ত তারা নুয়ে পড়ে। তুমি কি মনে কর স্রষ্টাকে পেয়েও কেউ তাকে আবার হারিয়ে ফেলে, কুড়িয়ে পাওয়া কোনো নুড়ি পাথরের মতো? তোমার কি মনে হয় না একবার পাওয়ার পর স্রষ্টাকে ধরে রাখতে পারে না সে তার কর্মফলের জন্যই? 
    
যদি বুঝতে পার তোমার শৈশব ও এতোদিনের জীবনে আদৌ তার অস্তিত্ব ছিল না, কিংবা থাকলেও টের পাওনি। যদি সন্দেহ হয়, মানুষের প্রতি আবেগি বিশ্বাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন যিশু, আর মুহম্মদকে ঠকিয়েছিল তার গৌরব যার ভিত্তি ছিল স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস ও মানুষের কল্যাণের চিন্তা; এখনো যদি এই ভেবে আতঙ্কিত বোধ কর যে স্রষ্টার কোনো অস্তিত্ব নেই। যাকে নিয়ে কথা বলছ তার যদি কোনো অস্তিত্বই না থাকে তবে তাকে হারিয়ে ফেলেছ এমন ভাবনার কোনো মানে হয়? এ বিষয়ে তোমার ব্যাখ্যা কী? আমাদের কাছ থেকে যে চিরতরে চলে গেছেন বা হারিয়ে গেছেন, তাকে খোঁজার মতো করে সৃষ্টিকর্তাকে তুমি খুঁজে বেড়াচ্ছ না তো?

এভাবে কেন ভাবছ না, তিনি আছেন, চিরায়ত তার অবস্থান, একদিন ঠিক এসে হাজির হবেন। তিনি সেই পরম বৃক্ষের ফল, আমরা যার লতাপাতা— এমনটা মনে করলেই পার। কেন ভাবতে পারছ না তার জন্ম হবে ভবিষ্যতের কোনো এক নিশ্চিত সময়ে, কালের গর্ভে। চারপাশে তাকিয়ে দেখ, একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে পৃথিবী। পুনরাবৃত্তি ঘটছে সবকিছুর। কোনো কিছুর শুরুটা সব সময়ই সুন্দর। স্রষ্টা যদি সবচে নিখুঁত হয়ে থাকেন, যার ভেতর ঘাটতি থাকে, জীবনের পরিপূর্ণ ঐশ্বর্যে তিনি তাকেই বেছে নেবেন নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে। তিনিই তো সেই জন, সব সুন্দরকে যিনি ধারণ করেন নিজের ভেতর, যার জন্য তৃষ্ণার্ত আমরা। যদি তিনি ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে বিরাজমান থাকেন তাহলে তার কি অর্থ দাঁড়ায় বলো? 
   
মৌমাছিরা যেমন ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে বেড়ায়, আমরাও সেভাবেই জড়ো করি পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এবং এভাবেই আমরা তাকে নির্মাণ করি। এমনকি যা তুচ্ছ, ক্ষুদ্র, ভালোবাসার মোড়কে জড়ানো, যা কিছু গড়েছি, আমাদের শুরুটাতো তা দিয়েই। এরপর আমরা এগিয়ে যাই শ্রম, বিশ্বাস, আনন্দ, মৌনতায়। অন্যের সাহায্য ছাড়াই যা কিছু নির্মাণ করি তার ভেতরই একান্তে স্মরণ করি তাকে। বেঁচে থাকতে কখনোই তার দেখা পাবো না আমরা, যেমন আমাদের অনেক পূর্ব পুরুষ দেখা পাননি আমাদের, বহুকাল আগে যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। এখনো তারা আমাদের মাঝেই আছেন, আমাদের ভাগ্যের বোঝা হয়ে, প্রবাহিত হচ্ছেন রক্তের শিরা-উপশিরায়। তারা আছেন কালের গভীরতায়। এমন কোনো শক্তি কি আছে যা তোমার বিশ্বাসকে বাধাগ্রস্ত করবে, যে তুমি এরই ধারাবাহিকতায় বেঁচে থাকবে তার মাঝে, এবং বিলীন হবে তার মাঝেই, দূরে বহুদূরে, সীমানার শেষ প্রান্তে যার অবস্থান।

প্রিয় কাপুস, এই গভীর ভাবনার মধ্যে কেটে যাক তোমার বড়দিন। হয়তো তোমার মানসিক যন্ত্রণার মধ্যেই জন্ম হবে তার। তিনি তাই চান। তোমার মনে এখন যা দাগ কাটছে সবই তাকে ঘিরে। তার জন্যই। যেভাবে ছেলেবেলায় তার জন্য কাজ করেছ একাগ্রচিত্তে, নিষ্পাপ মনে। ধৈর্য ধরো, মন থেকে ঝেড়ে ফেলো সব তিক্ততা, যেন তার আসার পথ নির্বিঘ্ন হয়। তার জন্য এটুকু তো করাই যায়! বসন্ত আসার আগে প্রকৃতিকেও তো প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। ভালো থেকো আনন্দ ও আত্মবিশ্বাসে।
                                                                                                                                                                      তোমার                
                                                                                                                                                             রাইনের মারিয়া রিলকে


( সৌজন্য - জাহানারা পারভীন অনূদিত  ‘রিলকে নৈশব্দ্যে ও নিঃসঙ্গতায়’  গ্রন্থ)



সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী
                            হিন্দোল ভট্টাচার্য


যোগাযোগ  ও লেখা পাঠানোর ঠিকানা - abahaman.magazine@gmail.com

লেখা পাঠাবেন অভ্রতে। মেল বডিতে পেস্ট করে অথবা ওয়ার্ড ফাইলে। কবিতা কমপক্ষে পাঁচটি পাঠাবেন। আমন্ত্রিত লেখাও অনুমোদনযোগ্য। প্রেরিত লেখা প্রকাশ পাবে কিনা, তা আমরাই মেল করে জানিয়ে দেব। অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই মাস। অনুবাদ পাঠালে মূল কবিতাও পাঠাতে হবে। কোনও লেখার কোনও শব্দসীমা নেই। 

No comments:

Post a Comment