Sunday, June 3, 2018

দূরত্বে ভালো আছে : তন্ময় ভট্টাচার্য


ব্যক্তিগত গদ্য




দূরত্বে ভালো আছে



(১)
আমরা পৌষের মাঠে বসে দেখেছি টিয়াপাখি ও ঘুড়ির একসঙ্গে উড়ে যাওয়া। বাসের মাথায় চেপে লাভপুর যাওয়ার সময়, ডালপালার ঝাপট খেয়েও গেয়ে উঠেছি তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দিব না।বাংলা মদের খোঁজে অন্ধকার থেকে আরও অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে, ক্লান্ত হয়ে পরস্পরের কাঁধ চাপড়ে বলেছি এই তো, আর একটুখানি!আমরা ঝগড়া করেছি, হাতাহাতিও। বাড়ি থেকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি একে অপরকে। বছরখানেক পর, হেসে জড়িয়েও ধরেছি। আমি আর সে। সায়ন্তন সাহা। বন্ধুরা যাকে শানুবলে ডাকি।

আমার অল্টার ইগো শানু। ওর পাশে রেখে নিজেকে যাচাই করেছি বারবার। গত দশ বছরে এমন একটা দিনও মনে পড়ছে না, যেদিন মনে হয়েছে শানুকে ছাপিয়ে গেলাম। এখন চাইও না আর। ভেতরে-ভেতরে আত্মসমর্পণ। আমি শানু হতে চাই। একই সঙ্গে চতুর ও উদাসীন। নির্জন এবং মুখর। খুঁড়ে-খুঁড়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করার জীবন চাই আমি।
কী হবে এমন করে? সরিয়ে রাখা মানে তো এক অর্থে নিজেকে ঠকানোও! চারপাশের পৃথিবী যখন ছুটছে, একটা লক্ষ্যের দিকে যখন নজর সবার, ‘আমি কেন হতেছি আলাদা’? এ-ভাব তো আমার নয়! মিলেমিশে, সবার সঙ্গে একাত্ম হয়ে একটা কবিতাজীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমি। তবু যে হচ্ছে না, ভেতরে-ভেতরে পালিয়ে যাওয়া পেয়ে বসছে, এর জন্য দায়ী কে? আঙুল তুলব শানুর দিকে। আমার এই ক্ষতিটি করেছে সে। অথবা লাভ। তবু, এখনও, স্বীকার করতে বাধা নেই চারপাশের বৃত্ত ও কোলাহল ছেড়ে শুধুমাত্র কবিতার সঙ্গে দিন কাটানোর মতো সাহস অর্জন করতে পারিনি আমি। শানু পেরেছে। পেরেছিল অনেক আগেই।

শানু যদি খারাপ কবিতা লিখত, অথবা নেহাত পত্রিকায় ছাপানোর জন্য চলনসই গোছের কিছু একটা কবিতাজীবনে ওকে অস্বীকার করতে পারতাম সহজেই। কিন্তু এমন একটা দিনও পাইনি, যেদিন এটুকু বিশ্বাস করতে পেরেছি আমি শানুর থেকে ভালো লিখি। এই বোধই আমাকে বারবার ছুটিয়ে নিয়ে গেছে বন্ধুর কাছে। জীবনের বাইরে, কবিতার ক্ষেত্রেও মনে-মনে আচার্যের স্থান দিয়ে বসেছি তাকে। নিজেকে প্রশ্ন করলে এ-উত্তর পাবই আজ থেকে সাত-আট বছর আগেকার দিনগুলোয় যদি সায়ন্তন সাহার সঙ্গে পরিচয় না থাকত, লেখালিখিকে কোনোদিন সিরিয়াসলি নিতামই না হয়তো। ওর সমালোচনা আর নির্দেশ আমাকে ঋদ্ধ করেছে। আপাত-নির্জনতা মুগ্ধ করেছে আমাকে। পরবর্তীতে, ছুটে গেছি বাইরের আলোর দিকেশানুকেও টেনে এনেছিলাম, সব দেখেশুনে পিছিয়ে এসেছেকবিতা ছাড়া, আর কিছুই অর্জনের চেষ্টা বা ইচ্ছে ছিল না ওর।

এত দেয়া নেয়ার পরেও
মনে রাখার মতন কিছুই হল না
তাই দীর্ঘ কবিতার বদলে রেখে যাচ্ছি নির্জনতা...


দুটো মন শুধু অনুবাদ করে চলে কিছু শব্দ
নিজের বয়ানে
অথচ শরীর ছুঁলে ভাষা পেত জোনাকি


প্রেমের পোশাকে যৌবন এসেছিল, বারবার...
সে আসেনি, সে আসে না



ভালোবাসা আসলে সেইসব কবিতা যার ডাকনাম আমি নিজেই দিয়েছি
                                                                  
(সংকেত)

(২)
নির্জনতার কবিযাকে বলা হয়, সেই জীবনানন্দের নির্জন স্বভাবের কারণ কী ছিল? আত্মকেন্দ্রিকতা। চারপাশের সঙ্গে ঠিকঠাক মানিয়ে না-নিতে পারা। তাই নিজেকে গুটিয়ে এনে কবিতার ভিতরে দিয়েই মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে আরও বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি কবির ক্ষেত্রেও দেখেছি এই প্রবণতা। কেউ স্বভাবে নির্জন, কেউ বা অভিমানে সরে গেছেন গতানুগতিকতা থেকে। নিজের মতো লিখে গেছেন একের পর এক স্মরণীয় কবিতা।
শানুকে কিন্তু অনেক ভেবেও ঠিক ওই গোত্রে ফেলতে পারছি না আমি। আত্মকেন্দ্রিকতা কমবেশি সবারই থাকে। কিন্তু আমি ওকে দেখেছি অনায়াসে সবরকম মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে। স্টেশনের ফল-বিক্রেতা থেকে শুরু করে সাঁওতাল গ্রামের গৃহবধূ ওর কাছে সহজ হয়ে যেত সবাই। আবার এই শানুকেই দেখেছি সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিনের পর দিন নিজের ছাদের ঘরে পড়ে থাকতে, একা। গান শুনছে, গিটার বাজাচ্ছে, দেওয়ালে ছবি আঁকছে আর লিখছে একের পর এক আপাত-অসংলগ্ন কিন্তু চমকে-ওঠা গদ্য। অস্থিরতা যেন ছিঁড়ে খাচ্ছে তাকে। কীসের অপ্রাপ্তি ওর? আমি জানি, নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজছে সে। কবিতাতেও আসা সে-কারণেই। আমার মতো মৃদু জিজ্ঞাসা নয়, একধাক্কায় তীব্রতার মুখোমুখি নিজেকে দাঁড় করিয়ে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ে শানু। নির্জনতার বুকে নখ বিঁধিয়ে ফালাফালা করতে চায় সমগ্র অস্তিত্ব। দেখি আর ভয় পাই। সরে আসতে চেয়েও পোকার মতো ঘুরে-ঘুরে হাজির হই ওর কাছেই। হাত রাখি কবিতায়। চমকে উঠি। দেখি, কী ভয়ংকর একাকিত্ব ও উপলব্ধি ছড়িয়ে আছে পরতে-পরতে। অভিমানও কি?

পুরনো মদ আর বান্ধবী
            চট করে নেশাটা আসে না
আসার পর অনেকক্ষণ হ্যাংওভার থাকে!


ঘড়িতে কটা বাজে জানি না
শুধু বুঝতে পারছি
, সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হল অ্যাশট্রে
যেটার থেকে দূরত্ব মাত্র তিন হাত।
দূরত্ব অনেকটা পথ
, দূরত্ব ঘোচবার নয়
দূরত্বে ভালো আছি...


কেন ভালো আছে ও দূরত্বে? কীসের থেকে দূরত্ব? নিজেকে কেন সরিয়ে নিল সমসাময়িক কবিতার বন্ধুদের বৃত্ত থেকে? কোনো অভিমান? রাগ? এই প্রশ্নগুলো আমাকে ভাবায় প্রায়ই। শানু কিন্তু সমাদর পেয়েছিল পাঠকের কাছে। সে-সময়, ২০১৪-১৫ সালে আমরা অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করতাম সায়ন্তন সাহার মতো কবিতা আমাদের বয়সিদের মধ্যে খুব কমজনই লিখতে পারে। ওর ভাষা, চিন্তা, প্রেজেন্টেশন আমাদের চমকে দিত। এমনকি, সিনিয়ররাও মানতেন সে-কথা। ভালো-ভালো লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপা হয়েছে, বেশ কয়েকটা উল্লেখযোগ্য কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানেও ডাক পেয়েছিল সে। জড়িয়ে পড়েছিল ভালোমতোই। কিন্তু ভেতরের পলিটিক্স ও নোংরামিগুলো সহ্য করতে পারেনি। সব দেখেছে, বুঝেছে, নিজে অংশ হয়েছে এবং হেলায় ছিঁড়ে ফেলেছে সব টান। এই অসম্ভব উদাসীনতা কি শুধুই ভালো না-লাগা? তাহলে আমি, ওর স্কুলজীবনের বন্ধু, এসব পঙ্কিলতা ওর থেকে দশগুণ বেশি জেনেও সরে আসতে পারছি না কেন?
কারণ, লোভ। পাঠকের লোভ, সমাদরের লোভ, প্রশংসা ও সর্বোপরি কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার লোভ আমাকে বেঁধে ফেলেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমার সরে আসাও যেন সাবাসি না-পাওয়ার অভিমান। আবার, ফিরে যাওয়ার মধ্যেও সুপ্ত লোভের ইন্ধন। নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে লেখা হচ্ছে কি? শানু বলেছিল – ‘তন্ময়ের কিছু বলার নেই, ওর শুধু লেখক হওয়ার আছে।বলেছিল তোর লেখা কিস্যু হচ্ছে না। এ বিগ জিরো। তুই ভালো সম্পাদক, ভালো বানান জানিস, অনেক বই পড়েছিস মানেই যে বাংলাভাষায় ভালো কবিতা লিখতে পারিস, তার কোনো মানে নেই। দু-বছর আগে বলা ওর কথাগুলোর সামনে বসে আছি চুপচাপ। উত্তর পাচ্ছি না। নিজেকে ডিফেন্ড করার জন্যেও তো একটু কনফিডেন্স দরকার! কোথায় পাব, ভাই?
প্রকাশকের থেকে অফার পাওয়া, কথা হয়ে যাওয়া এবং কবিতার বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরও পিছিয়ে আসে সে। যুক্তি দেয় – ‘একটা কবিতাও ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে কিচ্ছু লিখতে পারিনি। আবার নতুন করে শুরু করব সব। যদি কখনও লিখতে পারি, নিশ্চয়ই বই করব পরে। একবার নয়, দু-বার এমনটা করেছে সে। দেড় বছরের ব্যবধানে, দু-বার। বই করবে না, কারণ তার মতে কিছুই লিখতে পারেনি এখনও।
প্রথমবারের বেলায় পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিয়েছিলাম আমি। নাম রেখেছিলাম – ‘দূরত্বে ভালো আছি’, ওরই কবিতা থেকে ধার করে। মনে হয়েছিল, শানুর স্বভাব ও চরিত্রের সঙ্গে একমাত্র মানাতে পারে এই নামটাই। শানুও সম্মত হয়েছিল। পরে আমিই নাম বদল  করি – ‘খনি ও শ্রমিকের মধ্যেপ্রকাশক বিজ্ঞাপনও দিয়ে দিয়েছিল। হল না। বড় অসম্মানিত হয়েছিলাম সেবারঅন্যান্য বন্ধুরা, যারা শানুর খামখেয়ালিপনা মেনে নিতে পারেনি, দু-চারকথা শুনিয়েওছিল আমায়, যেহেতু বইটা করার ক্ষেত্রে আমার উদ্যম ও উৎসাহ ছিল সবচেয়ে বেশি। ভেতরে-ভেতরে তো পারিনি এখনও, কিন্তু বাইরের আমি কি তখনই শানুর থেকে সরে আসা শুরু করে দিইনি?

ভালোবাসা বলে যদি কিছু হয়ে থাকে
সে কথা জানে শুধু ফুসফুস


কারন এখানে দম নিলে
সূর্যের আলো আসে না

                (খনি ও শ্রমিকের মধ্যে)
(৩)
শানুর উদ্যমহীনতার কথা ভাবলে এখনও হাসি পায় মাঝেমধ্যে। অনেকবার বলেছিলাম কৃত্তিবাসে কবিতা পাঠাতে। পাঠায়নি। শেষে আমিই ওর মেইল আইডি আর পাসওয়ার্ড চেয়ে নিয়ে, পাঠিয়েছিলাম। ছাপাও হয়েছিল। শানুকে জানানোর পর, পত্রিকা জোগাড় করা তো দূরের কথা, ছাপা লেখাটা একবার দেখতেও চায়নি পর্যন্ত। কবিতা পাঠানোর সময় নামকরণ আমিই করেছিলাম। মনে নেই আজ আর। লেখাটা রইল

এক আনন্দময় হলুদফুলের দেশে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি মৃতরা আসলে বেঁচে থাকেন স্মৃতিতে, সেই স্মৃতির দেশে ভায়োলিন হল একটা অস্থায়ী ডাইরি আর তার মধ্যে ঢুকে যায় নিস্তব্ধ নিথর মানুষ, মুখে একটাও কথা নেই!

ব্যস, এটুকুই। এতেই সমগ্রকে ধরে ফেলেছিলনিস্তব্ধ নিথর মানুষটি কি সে নিজেই?
মনে পড়ছে বছর তিন-চার আগের কথা। সকালে কী একটা কাজে কলেজ স্ট্রিট গেছি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর আড়াইটে। এসে দেখি, বন্ধ দরজার সামনে সিঁড়িতে বসে ইট দিয়ে একমনে আঁকিবুঁকি কাটছে শানুআমি অবাক। কখন এসেছিস? – ‘এই মিনিট পঁয়তাল্লিশ হল।’ ‘একবার ফোন করতে পারলি না?’ – রাগত স্বর আমার। - কী দরকার! অপেক্ষা করতে ভালোলাগে। জানতাম, তুই তো ফিরবিই!বাড়ি ফিরে দু-লাইন লিখেছিল
সে না থাকায় একটাই অসুবিধে হচ্ছে
আমি বারবার ভুলে যাচ্ছি
, সে নেই!

এমনটাই শানু। নিজের ওপর অসম্ভব বিশ্বাস ওর। উপলব্ধিগুলোও তাই কোনো সংশয়ে ভোগে না, সরাসরি হাজির হয়। আরেকটা কবিতার আড়ালের গল্প বলেছিল আমায়। এক গ্রীষ্মের দুপুরে ওর মা শুয়ে আছেন মেঝেয়, চুলগুলো ছড়ানো চারপাশে। শানুর মনে হয়েছিল, মায়ের চুলগুলো যেন শেকড়। নেমে যাচ্ছে কোন অতলে – 

কোনো এক অজ্ঞাতবাসে
যত রঙ ছিল, সেই সবটুকু রঙ
শুষে নেয় মাটি...


মাটির উপর শুয়ে আছে মা
মায়ের শেকড় ছড়িয়ে যাচ্ছে উঠোনের মধ্যে


অথচ এই লেখাগুলো নিজের কাছে লুকিয়ে রাখতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। আমি জোর করে একসময় অনেকগুলো নিয়ে এসেছিলাম ওর বাড়ি থেকে। কেননা মাথায় ভূত চাপলেই কিস্যু হয়নিবলে সব লেখা ডিলিট করে দেয় সে। এমন হয়েওছে বেশ কয়েকবার। পরে চাওয়ায়, আবার ফিরিয়ে দিয়েছি।

জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘তোর কবিতাগুলো যদি কিছু না-ই হয়ে থাকে, তাহলে পাঠকের ভালো লাগে কেন? পাঠককে কি তুই বোকা ভাবিস? প্রকাশক যখন নিজে থেকে বই করতে চাইছেন, তোর প্রত্যাখ্যান কি পাঠককে অপমান করা নয়?’ উত্তর দিয়েছিল – ‘ভাই, যদি আমারই পছন্দ না হয়, পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া কি অসততা নয়?’ জবাব খুঁজে পাইনি। নিজে অসততা নিয়ে ঘর করছি দিনরাত, সে-জগতে সায়ন্তন সাহার মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় করে।

ইদানীং তাই ওর সঙ্গে কবিতা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। আমার সমস্ত ব্যর্থতা, ফাঁকিবাজি, অসাড়তা মনে পড়ে যায় শানুর সামনে গেলেই। নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে পারি না আর। আফশোস একটাই, প্রকৃতের কাছে পৌঁছনোর যে-পথ, তাও জড়িয়ে ধরছি না। কারণ জানি, একবার পথ বদল করে নিলে সারাজীবনের জন্য কঠিন প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হতে হবে আমায়। শানু এটা জেনেও সরে গেছে। যে চলে যায় সে ফেরে না, ফিরে আসে অন্য কেউ...’ – নিজের লেখাতেই এই উপলব্ধি ধরে রেখেছিল অন্য কেউহয়ে ফিরে আসার প্রস্তুতিপর্ব এখন তার। ফিরে সে আসবেই...

১.
হিব্রুকাঠের নৌকায় শুয়ে রাত পোহাচ্ছে রংমিস্ত্রী

মেষশাবকের ছবিতে সাদারঙের যত প্রলেপ তা আসলে কুয়াশা
সব অশ্ব অন্ধকারে নেমেছে, জল আর বাস্পের সঙ্গমে কৃষ্ণপক্ষ মেঘ
ব্রহ্মপুত্র গ্রামে এসে পালাগান স্তব্ধ হয়ে যায়,
সেই অরণ্যসুন্দর যুবাটি বৃন্দাবনে হারিয়ে গেছে প্রেমিকার সাথে
ওদের গোপন দরজা দিয়ে দুপুরবেলা ঘনিয়েছে যখন
একশালিকের মত খয়েরি আদরে কেউ বুঝি ফিরে ফিরে আসে
২.
গোটা একটা স্টেশন আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেল


...সেই যে গেল, গেল তো গেল, আর কিছুতেই এল না
যে চলে যায় সে ফেরে না, ফিরে আসে অন্য কেউ...
                                                  (পথ)

(৪)
এ-লেখা আসলে শানুকে সামনে রেখে নিজেকে খুঁজে বেড়ানো, সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া নিজেকে। নইলে এখন যা উদ্ধৃত করতে যাচ্ছি, অন্য সময়ে হয়তো পারতাম না। সম্মানে বাঁধত, এবং প্রকাশ্যে এলে লোকে-কী-বলবেভেবে অস্বস্তিতে পড়তাম। কিন্তু সেসব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলেছি, কেননা শানুকে চিনতে গেলে আমাকেও চিনতে হবে। আমার বিপরীতটিই শানু। বা শানুর বিপরীতটি আমি।
২২ জুলাই, ২০১৬। শানুর জন্মদিনে, ওর ঘরে বসে আছি আমি আর বিবেক। আড্ডা চলতে-চলতে কখন সাহিত্য ও নিজেদের লেখালিখির দিকে ঘুরে গেল আলোচনা। এবং, তীব্র ভাষায় আমার লেখালিখিকে আক্রমণ করল শানু। উঠে এল কবিতা নিয়ে ওর নিজের চিন্তা, দর্শনও। অলক্ষ্যে বিবেক ভয়েস রেকর্ডার চালু করে দিয়েছিল। সেই ফাইল আমার কাছে আজও আছে। কখনও অহংকার জমা হয়েছে মনে হলেই ফিরে যাই শানুর বলা কথাগুলোর কাছে। এখন আবার শুনতে শুনতে, দীর্ঘ কথোপকথন থেকে তুলে আনলাম খানিক বয়ান -
আমার মনে হয় না, তন্ময় কিছুই পেরেছে। আমার মনে হয় তন্ময় খুব বুলশিট কাজকর্ম করছে, বেলঘরিয়ার ইতিহাসটা বাদ দিয়ে। এছাড়াও কিছু লেখা ভালো লিখেছে, বাকি সব বোদা জিনিসপত্র। আমায় যদি কেউ স্ক্রুটিনি করতে বলে, আমি বলব সরান। এরকম মাল প্রচুর আসবে। আমার ভালো লাগে না। কিছু লোকের তো লাগেই। ...আমি এসব হিংসা বা জেলাসি থেকে বলছি না। আমি বলছি আমার টেস্টের জায়গা থেকে। শুধুই কবিতা বানিয়ে তুলব, বা বানিয়ে ফেলে দেব এটা যদি কোনো কবির মধ্যে একবার ঢুকে যায়, তার কবিতায় বেনোজল আসতে বাধ্য। ...আমার ভালোলাগাটা সর্বজনীন নয়, কিন্তু সর্বজনীন কিছু লেখার ভিত্তিতে ওর লেখাটা যখন ক্রিটিসাইজ করা হবে, ও উড়ে যাবে। ...ওর কিছু বলারই নেই বেসিকালি। ওর লেখক হওয়ার আছে। এটা বিপজ্জনক। এটা যদি ওর ভিতরে .১%ও এসে থাকে, এটা থেকে ওকে বেরোতে হবে। নিজের চূড়ান্ত সমালোচনা করতে হবে। ... ডাইরেক্ট চার্জ করো কবিতা নিয়ে। বলো, এটা কিছু হয়নি। সবাই খুব ইয়েসম্যান হয়ে গেছে আর ভাবছে খুব তাড়াতাড়ি কবি হয়ে গেলাম। খুব তাড়াতাড়ি সাফল্য, খুব চটজলদি লেখা এভাবে হয় না। ...আমার মধ্যে বোধহয় একটা অদ্ভুত ইনসিকিউরিটি কাজ করছে, জ্বালা-যন্ত্রণা কাজ করছে। আমি চুপ করে আছি কারণ হয়তো সময় নিচ্ছি। কোনো একটা দিন নিশ্চয়ই লিখব। লিখব না কি? ...বারবার ম্যাজিক হয় না, বারবার কবিতা আসে না। তখন যেটা হয় সেটা মৃত সন্তান প্রসবের মতো। একজন কবি তার স্কিল থেকে আবর্জনা ক্রিয়েট করবে, সে নিজেও জানে মেটেরিয়াল নেই। আর বলার কিছু নেই। ...তন্ময় যেন এটা কখনোই না ভেবে বসে যে আমি এবার কবি হয়ে গেছি। যেদিন থেকে ও এটা ভেবে বসবে, শেষ হয়ে যাবে। হয় না রে এভাবে। কটা কবিতা হয়ে ওঠে বল তো শেষ পর্যন্ত? কবিতা তো এটা! ছেলেখেলার বিষয় তো নয়!...
ওর কথাগুলো শুনে বিষাদগ্রস্ত ছিলাম অনেকদিন। সত্যিই কি কিছুই পারিনি? নিছক পুনরাবৃত্তিতেই কেটে যাচ্ছে দিন? আচ্ছা, যদি জীবনটাই পুনরাবৃত্ত হয়? যদি বিভিন্ন ঘটনায়, বিভিন্ন মানুষের মধ্যে দিয়ে প্রায় একই অভিজ্ঞতা আমার কাছে ফিরে-ফিরে আসে তা কি লেখা উচিৎ নয়? একবার লিখে ফেলেছি বলে পরেরবার কি দাঁতে দাঁত চেপে আটকাব নিজেকে? এও তো হতে পারে, হয়তো বিষয় প্রায় একই কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুনতর হয়ে ধরা দিচ্ছে আমার কাছে! শানু কি এটা বুঝছে? নাকি ওপর-ওপর বিচার করে রায় দিল শুধু?
আমি সৌভাগ্যবান এ-কারণে - এমন কয়েকজন বন্ধু পেয়েছি, যারা ব্যক্তিগত সম্পর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে আমার লেখালিখির চূড়ান্ত সমালোচনা করতে পিছপা হয় নাশুনতে খারাপ লাগলেও, আখেরে উপকারই হয় আমারশানু সেই সমালোচকদের মধ্যে তীব্রতম। নিজের যাপন থেকে উঠে আসা কবিতাবোধ ওর। আমার মতো গতানুগতিক নয়, সচল এবং আলাদা। যে-কারণে কবিতা সম্পর্কেও এত স্বচ্ছ ও দৃঢ় বক্তব্য ওর।
ওর একটা কবিতা প্রায়ই মনে পড়ে। কবিতাটার নাম যমুনা নিউজএই নামে বাংলাদেশের একটা নিউজ চ্যানেল আছে। হয়তো কোনোদিন ইউটিউবে ওই চ্যানেলে সম্প্রচারিত বন্যা দেখেছিল সে। কবিতা হয়ে যা উঠে এল, তা জীবনের মর্মন্তুদ ছবি

বন্যা চলছে।
এবং আল্লাহ্‌ ত্রাণ পাঠাতে ভুলে গেছেন


বৌ বাচ্চা নিয়ে মানুষটারে উঠে যেতে হল চালে
এই ঠান্ডায়, এখন রোজা আর নামাজের কথা মনে পরে তাঁর


মহম্মদের নাম নিতে নিতে
কালো রাত কেটে
সকাল হয়


আর সেইসঙ্গে শুরু হয় বজ্রবিদ্যুৎ সহ প্রবল ঝড়বৃষ্টি!
                                             (যমুনা নিউজ)
একটা দৃশ্যের ওপর নির্ভর করে আপাতসরল বর্ণনা। কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে রাখা অসহায়তা এমন প্রকাশের মুনশিয়ানা সমসাময়িকদের মধ্যে খুব বেশি দেখিনি। এই যে মানুষটারে লিখল ও, ‘মানুষটাকে’-র বদলে, যেন বাংলাদেশে গিয়ে লোকটার বুকে হাত রেখে বলে এল আপনার পাশে আছি। এই যে সহমর্মিতা, অন্যের ব্যথাকে নিজের মধ্যে উপলব্ধি করে তাকে কবিতায় প্রকাশ খুব কম দেখতে পাই আমাদের সময়ে। নিজের এবং শুধু নিজেরই কথা নিয়ে এত ব্যস্ত সকলে(আমিও), অন্যের দিকে নজর দেওয়ার সময় হয় না। সেখানে শানু কিন্তু বারবার চলে যায় মানুষের কাছে। শুধু দেখেই ক্ষান্ত হয় না, এগিয়ে গিয়ে অংশও নেয়। চরিত্র হয়ে ওঠে ঘটনার। কবিতায় তার ছাপ পড়বে এতে আর আশ্চর্য কী!
নিজেকে কখনও কবিভাবার স্পর্ধা রাখে না শানু। ওর মতে, ও দর্শক। আমার মতে, দ্রষ্টা। যে-কারণে অনায়াসে ছুঁড়ে দিতে পারে বক্রোক্তিও

কবিতা-কবিতা করে যে কবি পাগল
ছন্দে কাব্য তার
, সঙ্গে সনেট লিখে
স্কন্ধে গজাল তার ফুলের বাগান


...শক্ত কবিতা পড়ে হাসে ভগবান!

এবং, এই চারলাইনের উদ্দেশ্য হয়তো আমি এটা ভেবে ওকে ধন্যবাদ দিই প্রত্যেক পাঠে। শিখি। সব শেখার প্রয়োগ সম্ভব হয় না। কিন্তু অবচেতনে থেকেই যায়। একদিন-না-একদিন বেরিয়ে তো আসবেই!
(৫)
মাঝেমাঝে ওর প্রতি নেগেটিভিটি জাগে মনে। শানুর আচরণে কি ভণ্ডামি লুকিয়ে? ইচ্ছে করে নিজের এই উদাসীনতার ইমেজ তৈরি করছে, যাতে কেয়ারলেস প্রতিভা গোছের তকমা পায়? এ-ধারণা আমার মাথায় ঢুকিয়েছে কয়েকজন সমসাময়িক বন্ধুই। হঠাৎ করে অস্বীকারও করতে পারি না কথাটা। আবার মনে হয়, শানু যদি এমন না হত, তাহলে এটাও হয়তো লিখতে পারত না

পৌঁছনো নেই এরকম বিকেলে রথীনদা-কে খুঁজে পাওয়া যেত খালাসি-তে
পাঞ্জাবির পকেট ভর্তি আলো নিয়ে রথীনদা তখন একমনে
ধারবাকি মদ টিমটিমে আলোর সাথে খুচরো খুচরো হয়ে পেট চালান

বাংলা আর সন্ধে ভাজা চিবোতে চিবোতে
অফুরান বাসের লাইন আর তাঁর কুমিরগন্ধ নিয়ে রাস্তা পার...

রথীনদার একজন পোষা মেয়েমানুষ ছিল
মেয়েমানুষের গল্প যেমন হয় আরকি

তবে রোজকার মতো সেদিনটা ছিল না
মদ, কোলকাতা আর বৃষ্টির পর ঝিরঝিরে হাওয়া

সেদিন নেশার ঘোরে কে কী বলেছিল আজ সবটা মনে নেই
তবে আমরা বোধহয় ঠিক শুনেছিলাম -

ডাকার দরকারটাই বা কী
আর নিতান্ত ইচ্ছে হলে না হয়
                 বৌঠান বলেই ডেকো!
                                    (মাতাল)

ওর ঘুরে বেড়ানো কলকাতার আনাচে-কানাচে, মফঃস্বলের বস্তিতে, ট্রামলাইন ধরে, গঙ্গার ঘাটে, ঝিলপাড়ের নিভৃত কোনো শান্তিতে, নয়তো নিছক ঘরের দরজা বন্ধ করে দিনরাত আত্মখনন এই ভ্রমণ ওকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে দেখার অ্যাঙ্গেল না থাকলে এসবের কিছুতেই কিছু হত না। দেখা এবং ভাবা, তার সঙ্গে কবিতার তার প্রয়োগ এভাবে যে শরীর তৈরি হল, তা সায়ন্তন সাহার নিজস্ব। নেশা ওকে নিমজ্জন দিল। কান্না দিল পরিণতি। বব ডিলান থেকে প্রতিবাদ আর পিকাসো থেকে চাঞ্চল্য নিল সে। আমার থেকে ভরসা আর কবিতা থেকে বাঁচার রসদ হয়ে উঠল একজন শিল্পী। যার ছাপ গিয়ে পড়ল গদ্যেও

...আমার রাজনীতি, শরীরভীতি মগজধোলাই এবং চোলাই-এর বাসনা যুক্ত তীব্র রাগ আর গা গরমগুলো তুমিই শুধু বুঝতে, তাই কষ্ট পেতে হয়েছে তোমাকেই, বারবার, হয়তো আগামীদিনেও হবে; আর আমি সরি বলতে বলতে একসময় ভেঙে ফেলব নিজেকে, তাই সারাদিনে অকারণ, অবিরাম যত্রতত্র ভালোবাসা থেকে ল্যাগ করে যায় আমার ঈশ্বর, ১৮০ ডিগ্রি!

এই যে ল্যাগকরে যাওয়া, এই প্রয়োগ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র হয়ে খুব ভালোমতোই বুঝেছে সে। আমরা দুজনেই ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছি। সার্কিট থিওরির লিড-ল্যাগ কনসেপ্ট যে এভাবে ঈশ্বরের প্রতি অ্যাপ্লাই করা যায় তাও আবার একশো আশি ডিগ্রি বোধ কী পরিমাণ প্রখর হলে এমন লেখার জন্ম হয়! শানুর গদ্যে বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সহাবস্থান আমাকে আজকাল বিস্মিত করে না আর। এবং মেনে নিয়েছি, সমসাময়িকদের মধ্যে ওর থেকে তুখোড় কেউ নেই, অন্তত এই আঙ্গিকে। আরেকটা উদাহরণ দিই, ফিজিক্স যেখানে জীবনের আলো মেখে পাশের বাড়ির লোকটি হয়ে আছে

দেখুন কীভাবে দুটি ব্ল্যাকহোল পরস্পর মিলিত হচ্ছে, আর এই মিলনের ঠেলায় এরা মেতে উঠেছে বন্য খেলায়, যার ফলে সময় এর বেসিক গঠন অবধি নিজের মতন করে বেঁকিয়ে নিচ্ছে, ব্ল্যাকহোলের খুব কাছে সময়ের হিসেব পৃথিবীর হিসেবে মিলবে না, কারণ স্থান আর কাল'কে এরা নিজস্ব কায়দায় অদ্ভুত ভাবে বাঁকিয়ে নিতে পারছে, এর ফলে তৈরি হচ্ছে ক্যাওস এবং বহুবিধ প্যাটার্ন, এই নানারকম প্যাটার্ন নিয়ে ভাবতে বসে আর শেষ অবধি কোথাও গিয়ে আশ মেটে না। এই বহুরকম প্যাটার্ন আর অদ্ভুত সিকোয়েন্স আর তার মধ্যে লুকিয়ে আছে যত সহজ আর সাংঘাতিক, সেই সব অণু-পরমাণুর প্রতি নতজানু হয়ে আছি...

আমি কী খুঁজছি, অথবা খুঁজতে চাই? মহা রসের কোনো বিরাট ভাণ্ড, প্রাচীন কোনো অমৃত সংকেত, এমন কোনো কিছু, যা আলো অথবা শব্দের মত ইউনিক, মানুষ জীবনের অনন্ত পিপাসা নিয়ে দেখতে থাকি, আমার মায়ের মুখ আর যোনিদ্বার ভেঙে, আমি আর আমার মত কোটি কোটি আত্মা উড়ে চলেছে মোহাবিষ্টের মতন, এই যাত্রা সেই চিরকালের। তবু কীভাবে যেন হারিয়ে গেছে সেই দেশ! আর ফেরা যাবে না...

এখন মায়াগনিতে পা ডুবিয়ে বিরাট কোনও পর্বতের ধারে বসে আমি দেখি, দোল দোল করতে করতে মা আমকে ঘুম পাড়াচ্ছে,এই খেলনা শরীর মায়ের মৌতাতে বড় হয়, অথচ কী দুর্ভাগ্য যে মাথা এবং চোখ একেবারে ভুলে গেছে সব, তারপর, তারপর ঠিক কী লিখতে চায়।
শুধু একটা কথা ভেবে দেখেছেন, সবার প্রথমে কী ছিল? কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে সিঙ্গুলারিটিহল এমন একটা সার্টেন পয়েন্ট মানে নিশ্চিত একটি একক বিন্দুযেখান থেকে সব কিছু স্টার্ট হল, কোনো কিছু নেই এমন একটা অবোধ্য ভ্যাকুয়ামের মধ্যে প্রকৃত শূন্যাবস্থা কল্পনা করা খুব দুরূহ ব্যপার, আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সেই মূল বিন্দু মানে ওই আদি অনন্ত ওই মহাবিন্দুর পেছনের যে কাঠামো তার দিকে এগোতে চাইছি মাত্র
ছিল ব্ল্যাকহোল, হয়ে গেল রুমাল, এই ধাঁধার কোনো বাঁধাধরা সমাধান নেই, যেহেতু অসমীকরণ তাই লিমিট দিয়ে কিনেছি সভ্যতা, ভুল বলে কিচ্ছু নেই, শুধু একটা আপেক্ষিক ভুবনের নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমি বা আমরা কেবল পালিয়ে যাচ্ছি টাইম ডোমেন থেকে অন্য টাইম ডোমেনে!
এই ছেলেটা আর লিখবে না! লিখলেও, পাঠক তার লেখার ছোঁয়া পাবে না! ভাবতে গেলে হতাশায় ডুবে যাই। মনে হয়, আমার মতো অযোগ্য একজনও যদি সামান্য হলেও পাঠকের কাছে পৌঁছোতে পারে, শানু কী আদরই না পেত! ক্ষমতা দখলের দরকার নেই ওর। বিখ্যাত হয়ে ওঠারও না। শুধু, যদি ওর লেখাগুলোকে সাধারণ মানুষের সামনে এনে রাখত একটু! এখানে শানু আমার ছোটবেলার বন্ধু না, ফুটবলের স্ট্রাইকার অথবা গার্লস স্কুলের সামনে ঘুরে-বেড়ানোর সঙ্গীও নয় ও কবি। যদি সত্যিই বেরিয়ে না আসে, কে জানে, আমি নিজেই হয়তো একদিন ভিতরে ঢুকে যাব। তারপর? জানি না...

(৬)
শেষ অবধি নির্জনতা কী? আত্মস্থ দশা ছাড়া নির্জনতার অন্য কোনো অর্থ খুঁজে পাই না আমি। সায়ন্তন সাহা নিজের চাঞ্চল্যে আত্মস্থ। আমি নিজের আত্মস্থতায় চঞ্চল। তবু আমরা দুজন আছি, শিক্ষক ও ছাত্র হিসেবে। বন্ধু হিসেবে। আর আছে আমাদের লেখালিখি, যা বেলঘরিয়ায় দুজনের দুটো বাড়িতে জন্ম নিয়ে অপেক্ষা করে আছে সততার। আমার অপেক্ষা পাঠকের। শানু চায় বিষণ্ণ একটা দেওয়াল, যার কাছে বলে আসা যায় যা-কিছু পারেনির হিসেব। আমরা একসঙ্গে হাঁটতে বেরোই। শানু চলতে চলতে দাঁড়ায় হঠাৎঝুঁকে দেখে নিতে চায় ফুলের শেষ পরাগরেণু। আমি এগিয়ে গিয়েও থমকাই। তখনও ঝুঁকে আছে সে। আমি ওকে দেখি। পরাগরেণু দেখা হয়ে ওঠে না আর।
এভাবেই চলতে থাকে, কেটে যায় আমাদের না-হওয়া দিনগুলো। অথবা হচ্ছে কোথাও, টেরও পাচ্ছি, স্বীকার করছি না কারণ পরস্পর মুখোমুখি হয়ে পড়ব, দীর্ঘ বিচ্ছেদের আগে সামান্য কিছু আড্ডা হবে আমাদের। আলাদা হতে ভাল্লাগে না আর। তার চেয়ে আলাদা থাকা ভালো। আমি আছি। সে আছে। এর বেশি কীই বা চাই!

সায়ন্তন সাহার কয়েকটি কবিতা

অকালবোধন

ঐ দেখো, কারা যেন ভেসে যায়, ঐ বুঝি মানুষের লাশ
সহজিয়া নদীচরে বিষাদের খই, কীর্তন বোবা হলে
এলোমেলো ছাই ওড়ে শ্মশানের ঘাটে...

এই নাও কবরের মাটি
মায়ের প্রতিমা হবে, এই মাটি দিয়ে
কৃষ্ণপক্ষ জুড়ে, অন্ধ ফকির আঁকে মুমতাজ চোখ

অকালবোধন রাই
জাগো, তুমি জাগো... 

গরু থেকে গল্পের আগে অবধি

পরীক্ষা দিতে গিয়ে কিছুই পারছি না
পাশে বন্ধুরা মন দিয়ে লিখছে...
ওদের লিখতে দেখে মনে হয় প্রস্তুতির কথা
প্রস্তুতি কিন্তু ফেসবুকে নেই
নির্বোধ হয়ে সারদিন ফেসবুকেই কেটে যাচ্ছে তন্ময়
আমার দিকে কেউ তাকিয়ে নেই
সত্যি সত্যি

এর মধ্যে এক ঘণ্টা কেটে গেছে, কী ব্যস্ততা
আমি শুধু মন দিয়ে ছবি আঁকি
আঁকতে আঁকতে সময় যায়

(ঐ ঘটনার অনেক দিন পর)
...একটা ভালো শনিবার দেখে
বেচে দিয়েছি সমস্ত মার্কশিট

কাগজওয়ালির টেলিফোনও নেই,  দেখাও নেই!


পুরনো সুর দুহাত দিয়ে ছুঁই

যে সমস্ত প্রেম রেকর্ড করে রাখা ছিল অন্য কোথাও
তাদের সাথে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল ধর্মতলায়
এমন খুব জ্বরে, মদের পিপাসা পায়
বেশি বেশি মদ খেয়ে আমার মধ্যে বটগাছটা কেঁদে ফেলে

আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা, চৈতন্যময়ী...
একসঙ্গে সব কাক উড়ে গেলে - গাছেরও ব্যথা লাগে

ঘুঘুডাক

আমাদের পাড়ায় একটা পাগল আছে - জগা
জগা যে ক্রমেই গাছ হয়ে উঠছে
একথা বুঝত শুধু পারুল বৌঠান
মাথার ভেতরটা খুব গোলমাল করছিল দিন কয়েক
আসলে গাছেরাও মিথ্যা ধরতে পারে, শনাক্ত করতে পারে খুনিকে
সব দোষ আসলে মনেরই ছিল
আগ্রাসী চুম্বক খেয়ে ফেলছে সব সন তারিখ
নিরেট অন্ধকার রাস্তায় নিভে গ্যাছে জগা
যেমনভাবে রাতজাগা গ্যাসলাইট চলে যায় ঘুমের দেশে
তারপর বুকে ক্লোরোফিল বাসা বাঁধলে
জগার কৃষ্ণশিস ঘুঘুডাক উপহার দিত সংহারিণী রাত

আ বো ল তা বো ল

আমার বাবা মা যেভাবে ভালোবেসে অথবা সংসার নামে
সারাজীবন থেকে গেল, এই সারাজীবন থেকে যাওয়াটা একটা রহস্য
এবং কিছুটা অসুস্থতা, আমার কাছে...

বাবার বিয়ে নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে চাইনি
মায়ের বিয়ে নিয়েও নয়...
তবু মায়ের সাথে জুড়ে আছে যে সমস্ত বাড়ি
তারই মধ্যে ঢুকে পড়েছি অন্ধকার রাতে

প্রতি মুহূর্ত খুঁজি তন্ন তন্ন করে
ভোর হয়ে আসে
, আমি তখনও খুঁজে যাচ্ছি
বাবার প্রেমিকার নাম...


শীতকাল এলেই

একটা গাছের ডান হাতে খুব ব্যথা,
তাই ফুল ফোটাতে কষ্ট হয়, হাত সরালেও ব্যথা লাগে

শীত আসার আগে থেকেই গাছটার মনে মনে খুব ভয়
এই বুঝি ব্যথা বাড়ে, এইসব কথা ভাবতে ভাবতে দিনগুলো ছোট আর রাতগুলো
বড় হতে শুরু করে, বড় বড় রাত ঘন কুয়াশায় ভিজে ওঠে পাতা

ঠান্ডা সঙ্গীত চুঁইয়ে পড়ে গাছের শরীরে
তা একদিন সারারাত কিচ্ছু না খেতে পেয়ে এক কালো কুকুর
এই গাছের কাছে প্রথমবার এসেছিল
সেই থেকেই বন্ধুত্ব। সেই বন্ধুত্ব এখনও চলছে
...

ভ্রম ও ভ্রমণ
তেমন বিশেষ কিছু নয়
এক সুন্দরী বটগাছ, গ্রামের ভেতরদিকে

ওর গায়ে ঘুঁটে দিয়ে চলে গেছে কতগুলি মেয়ে বৌ
সবার অজান্তে, গাছের কাছে গিয়ে দেখি
প্রতিটা ঘুঁটের গায়ে আঙুলের ছাপ

সেই হাতের পাতা অতটা মসৃণ নয়
সেই হাতের দিকে চেয়ে আছি, অন্ধ জাতিস্মর
!


No comments:

Post a Comment