Sunday, June 3, 2018

নীরবতার উপাসনা , সমসময় , ভেঙে যাওয়া মুখ ও একটি প্রদীপ: কুন্তল মুখোপাধ্যায়

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি






                                           নীরবতার উপাসনা , সমসময় , 
                    ভেঙে যাওয়া মুখ ও একটি প্রদীপ




কে কবি ?
যখনই ভাবি একজন শালপ্রাংশু দাড়িওলা মানুষ এসে সামনে দাঁড়ান । তাঁর প্রতিবাদ প্রবণতার কথা ভাবি । জালিয়ানয়ালাবাগ । সেই ঐতিহাসিক চিঠি যা রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী শুনতে চেয়েছিলেন এমনকি মৃত্যুমুহূর্তেও ! ভাবি দ্য ইংলিশম্যান কীভাবে আক্রমণ করেছিল তাঁকে ।ভাবি ,সেই চিঠি লেখার পরে ১৯২০-২১ সালে যখন চতুর্থবারের জন্য কবি ইংল্যান্ড যাচ্ছেন তখন তাঁকে ঘিরে তাঁর অনুরাগীদের সেই উষ্ণতাটাই ছিল না ,রবার্ট ব্রিজের মতো পুরনো বন্ধুও কবির সংবর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করতে চাইছেন না । ভাবি , দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানে কবি সতর্ক করে দিচ্ছেন অতি আগ্রাসী রাস্ট্রবাদকেই । কিন্তু জাপানীরা ভুল বুঝছে তাঁকে । যে কবিকে তাঁরা লাল কার্পেট পেতে অভিবাদন জানিয়েছিলেন , সেই কবিকেই তাঁর জিনিসপত্র নিয়ে প্রায় একা একাই ফিরে আসতে হচ্ছে 
আপাতভাবে যাকে দেখে মনে হয় অশক্ত , দুর্বল , সেই মানুষ কিন্তু অন্তরের শক্তিতে ভীষণ সজীব , ভীষণ বিদ্রোহী । আর তাঁর দায় শুধু সত্যের কাছে , ইতিহাসের কাছে । ভাবি ,ভিক্তর জারার কথা । কীভাবে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি লিখেছেন একের পর এক প্রতিবাদের কবিতা । তাঁর কব্জি , হাত  ভেঙে দেওয়া হয়েছে , তবু বেড়িয়ে এসেছে তাঁর সেই কবিতা যা পিট সিগার গাইছেন – উই আর সেভেন থাউজ্যান্ড । লোরকার লেখা । তাঁকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই অসামান্য কবিতা । কীভাবে ‘শাসকের প্রতি’ ( জয় গোস্বামী ) গৃহীত হচ্ছে মানুষের কাছে । কীভাবে সেই পরিবর্তনের সময়ে তিনি লিখে ফেলছেন সেই লেখা – তারপর সেই মৃত নগরীর রাজা হয়ে কি হবে তোমার অয়দিপাউস ...
কিন্তু রাজা পরিবর্তন হলেই কি আর দিন বদলায় ? আগে যাঁদের পড়ে , শুনে শিখছিলাম ,দেখছিলাম ,আমাদের সময়ে কীভাবে বুদ্ধিমান মানুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন , এই ভেবে চমৎকৃত হচ্ছিলাম , সেইসব মুগ্ধতা ভেঙে দেওয়ার জন্যে সময়েরও কিছু দেওয়ার ছিল । দেখলাম , তাঁরা ক্রমশ অঙ্গীভূত হয়ে পড়ছেন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের । দেখলাম তাঁরা কীভাবে অলংকৃত করতে থাকলেন বিচিত্র সব পদ । যে মুগ্ধ যুবক ভাবত পরিবর্তনের সরকারে ভূমিকা আছে তারও , কারন  তারই প্রিয় মননজীবীরা শাসককে শিক্ষা দিতে বিরাট ভুমিকা নিয়েছেন , তারও শিক্ষা হল একদিন । নেতৃত্ব ঘোষণা করলেন কোনও নির্দিষ্ট কারোর জন্যে বা কোনও সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের জন্য নয় , দলের সংগঠনই সবচে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে  সংকট কাটিয়ে পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে  আর তার পরেই জলচ্ছ্বাস খবরের , লজ্জার  বাক্যবন্ধ চালাচালি । কবিরাও যেন  নিঃশব্দে গাইতে লাগলেন – এবার নীরব করে দাও হে তোমার মুখর কবিরে
মেধা আর বুদ্ধিরও যে কিছুমাত্র ভূমিকা আছে , এটা ক্রমশ ভুলতে ভুলতে এমন জায়গায় সে এসে পড়ল , যখন তারই ছোট্ট শান্ত মফসসল শহরে মাস্কেটিয়ার্স বাহিনী এলো নেমে । গুলি ছুঁড়ল শূন্যে । সাদা সাদা ঊড়নি নেওয়া জনগন পথরোধ করে দাঁড়ালো তার । তাকে বলল , স্যর আপনার ব্যাগ দেখি । বোমটোম নেই তো ! চারিপাশে শান্তিরক্ষী বাহিনির ছায়ামাত্র নেই ! সে কিছু বলবে বলে ভেবেছিল । কে যেন তাকে আঙুল তুলে বলল ভাই চুপ করো । নিজের জীবন বাঁচাও । সে আশাভরে তাকিয়ে থাকলো অগ্রজদের দিকে । তাঁরা নিস্তব্ধ । বোধের জগতেও কি তাহলে নেমে এলো ভয় ?
তাকে কেউ বলল তাদের গ্রামে এক বস্তা নাইন এম এম পিস্তল এসে গেছে । আর ভয় নেই এখন কোনও ধর্মের মানুষ এলে তাকে উচিত শিক্ষা দিতে পারবে সে । সে জানল , এইসব বন্দুক কীভাবে চালাতে হয় তারও ট্রেনিং চলছে । অত্যন্ত কমবয়সের একজন তাকে বোঝাল দেশি আর ইম্পর্টেড বন্দুকের পার্থক্য কী । সে কিছুই বলতে , লিখতে পারল না । শুধু মনে করতে পারলো তার শহরের রাস্তায় মাস্কেটিয়ার্স তাদের বোম , তাদের গুলি , তাদের ঔদ্ধত্যসে ভাবল , নিজের দেশকে শেষমেশ তাহলে তারা নিয়ে এলো এই জায়গাতেই !
বিতর্কে তাকে পক্ষপাতদুষ্ট বলা হল ।বলা হল , সে যেন শুধু নিজেদেরই ভুল দেখতে ব্যস্ত । সে কি দেখেনি , কীভাবে একটা ধর্মের সম্মন্ধে একটা পোস্ট হলে ধর্মন্মাদ মানুষেরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নেয় , ধ্বংস করে ফেলে এমনকি পুলিশ চৌকিও ! সে দেখছে এইসব ধর্মন্মাদদের জন্য কীভাবে নীরবে কষ্ট পাচ্ছেন সেই ধর্মের অসংখ্য মানুষ । কেমন করে তাদেরকেও বলে উঠতে হচ্ছে এরা এই উন্মাদরা আমাদের কেউ নয় । আমাদের দেশ ভারতবর্ষ । কীভাবে তার কাছে এসে চোখের জল ফেলছেন মেয়েরা । অথচ বলার মতো কোনও ভূমিকা নেই কবির । তিনি স্পষ্ট কথাটা যে বলতে পারছেন না । স্পষ্ট আত্মপোলব্ধির কথা বলতে পারছেন না কেউ !
আর এইটুকু কথা বললে কাউকে কাউকে হয়ে যেতে হচ্ছে গেরুয়াবাহিনির সিম্প্যাথাইজার । সে অভিযোগ শুনতে পাচ্ছে যে এগুলো সব ম্যানুফ্যাকচারড । আজ যখন কবির তৈরি চরিত্র রাম হয়ে গেছেন জীবন্ত , হয়ে গেছেন আর এস এস পক্ষপাতী , তোষণবিমুখ মানুষের ইন্টেলেকচুয়াল ক্যমাফ্লাজ , তখন কি কবিরই জয় হচ্ছে না ? হচ্ছে না কারন রামের সামগ্রিক ধারণার চেয়ে আংশিক ধারণা প্রাধান্য পাচ্ছে । এমন একটা সময়ে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা করছেন কলকাতার শিক্ষিত , মননশীল মানুষেরা । কিন্তু এতদিনে তাঁদের আর নিরপেক্ষ অবস্থান আর নেই । বুদ্ধিজীবী নাম উঠলেই হাসাহাসি । ম্লান মফসসলে  যে কবিতা লেখে, তাকে নিয়মিত শুনতে হয় – বুদ্ধিজীবীরা কি করছেন ?
শোনা যায় আরও এক প্রকৃত সাম্যবাদীর গল্প । সে এসে বলেছিল যে তার কাছে সব পার্টি সমান । সবাইকে সে ছোট বড় মাঝারি বোম সাপ্লাই করে । শোনা যায় একটি লটারি বিক্রেতার গল্প । পয়সা নিয়ে নিয়ে যে স্বপ্ন বিক্রি করে । তার কাছে শুনতে পাই কেউ কেউ স্বপ্নটিকিট নিয়ে সারা রাত ঘুমান না । সকালবেলা এসে স্বপ্নসন্ধানীর সঙ্গে বসে থাকে ।সারাদিন । আবার সূর্যাস্তে সে কিনে ফেলে আরও একখানা আশাবাদ ।  আজকাল স্বপ্ন দেখা কি এমনই মারণ কেনো লটারির নেশা ? যে নেশা ঘর বাড়ি সবকিছু শেষ করে দেয় । সে ভাবে , অগ্নীশ্বর ছবির সেই অমোঘ বাক্য , দেশই একমাত্র আবেগ । সে দেখে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে । শুধু প্রতিবাদ হচ্ছে , কিন্তু নির্বাচিতভাবে । তখনই মনে পড়ে যায় আবার সেই দাড়িওলা ঠাকুর । যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এক মহামানবের ।
ভাবি  নাইটহুড প্রত্যাখান করার পরে , ১৯২০ সালে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকছেন হান্টার কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে তৈরি বিতর্কে এবং আশাহত হচ্ছেন যখন বুঝছেন যে ডায়ারের ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত লঘু করে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে ।ডায়ারকে নিয়ে কিপ্লিং-এর লেখাটা এখানে অনেকের মনে পড়ে যাবে । ডায়ারের মৃত্যুতে কিপ্লিং লিখেছিলেন  যে তিনি “did his duty as he saw it” । যাইহোক তথ্য বলছে যে এই জহ্লাদ ডায়ার ছিলেন ইংল্যান্ডে খুবই জনপ্রিয় ( যদিও হাউস অব কমনস  তাকে ভারতের কর্মটি থেকে বরখাস্ত করে )।তাকে দান করার জন্যে একটি ইংরেজি দৈনিক ছাব্বিশ হাজার পাউন্ড  তোলে , যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ নাকি ভারতীয়দের দান ছিল । রবীন্দ্রনাথ প্রতিনিধিস্থানীয় ভারতীয়দের স্বাক্ষরসহ একটি স্মারকলিপি তুলে দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর হাতে এই অনুরোধসহ যে দুদেশের সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে যেন ভারতের ভাইসরয়কে সরিয়ে নেওয়া হয় । তাঁর এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে , ১৯২০সালে  বিফল মনোরথ হয়ে প্যারিস চলে যাচ্ছেন  । এমনকী রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংকলন করতে ম্যাকমিলানের মতো প্রকাশক ভয় পাচ্ছেন  “ to publish the most outspoken of them because of the risk of being charged with sedition under British Laws then in force ” বারেবারে তাঁর গতিবিধির নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছে সংবাদমাধ্যম , বিশেষত যেখানে তিনি আর গান্ধীজী বিদেশী পোশাক বর্জনের ব্যাপারে ভিন্নমত হচ্ছেন । কিন্তু এইসব ঘটনার বহু পরেও তিনি লিখছেন সভ্যতার সংকট !
আশার কথা এই ভয়ঙ্কর সময়েও একটি নিঃশব্দের শিখা জ্বলে আছে আমাদের দেশে । নিজের নৈশব্দসাধনা তাঁকে নীরব করে রাখতে পারে নি । চিরদিন প্রতিবাদে বিশ্বাস করে এসেছেন । এখনও , এই সময়ে , তাঁর প্রশ্রয়ধন্য যখন অনেকেই  চুপ , তিনি প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন । মুর্খেরা তাঁকে নিয়ে অসভ্যতা করছে , তবু তাঁর স্তব্ধতা , আলো আর প্রচার থেকে তাঁর দূরে থাকা বানিয়ে তুলেছে তাঁকেই আমার এই লেখার আত্মা , তিনিই আমার মিছিলের সেই মুখ । যিনি নৈশব্দ দিয়ে আর নীরবতা দিয়ে তৈরি করেছেন তাঁর লেখা , আর কখনও নীরব থাকেননি , যখনই মনে হয়েছে প্রতিবাদ করা দরকার । এমন দৃঢ়চেতা মানুষই এসময়ে আমার কবি । দূর থেকে তাঁকে প্রণাম জানাই

গ্রন্থ ও ভাষ্যঋণ 
১। Poets to a poet , introduction by Bikash  Chakravarty , Visva- Bharati , 1998 , page 46-47
২। সভ্যতার সংকট , রবীন্দ্র রচনাবলী , পশ্চিমবঙ্গ সরকার , ১৯৯০
৩। ইউকিপিডিয়া
৪ । শাসকের প্রতি
৫। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণ , স্থান রামপুরহাট কলেজ 
  

1 comment:

  1. লেখাটি ভাল। প্রাসঙ্গিক। দরকারি। শুরুর যে অংশটুকু ভাল লাগেনি, তাই ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেছিলাম।

    ReplyDelete