Sunday, June 3, 2018

সাইলেন্ট মোড : শিবু মণ্ডল


ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি








                                   সাইলেন্ট মোড

ঘুমিয়েই পড়েছিল হয়ত দিবাকর। কেবিনে কারও ঢোকার আওয়াজে চোখ খুলে গেল। রাকা এসেছে দেখা করতে।

-কেমন আছেন দাদা?
দিবাকর স্মিত হাসি দিয়ে শুধু হাত নাড়ে। রাকা বুঝে নেয়। কেবিনে ঢোকার আগেই কর্তব্যরত নার্সিং স্টাফ বলে দিয়েছিলো যে পেশেন্টের কথা বলা সম্পূর্ণ বারণ। তারপরও তার মুখ থেকে প্রশ্নটি বেরিয়ে এসেছিলো। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে দিবাকরের পাশে দাঁড়িয়ে আলতো করে দুটি হাতের মধ্যে দিবাকরের একটি হাত স্পর্শ করে তার ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠা টের পেল। দিবাকর হাতের ইশারায় রাকাকে পাশে রাখা সোফাটিতে বসতে বলল।   
বালিশের পাশে রাখা স্মার্ট মোবাইলটা নিয়ে ফেসবুক খুলে বসে দিবাকরটাইমলাইনে স্ক্রোল করতে করতে রাকার একটি পোস্ট দেখতে পেল। কাল রাতেই পড়েছিল লেখাটা। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘর্ষের একটি ঘটনার প্রতিবাদে এই পোস্ট। এই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবি-লেখকদের একটা অংশ নীরব কেন সে প্রশ্নও তুলেছে লেখাতেলাইক করেছিল সে কিন্তু কোনও কমেন্ট করেনি। আজ আর একবার পড়লমেসেঞ্জারে লিখলো –‘কি হবে এমন প্রতিবাদী লেখা লিখে। যাদের উদ্দেশে এমন লেখা তাদের কাছে কি আদৌ পৌঁছবে এমন লেখা? নাকি শুধু আমাদের মনকে অস্থিরতা থেকে মুক্ত করার জন্যই লিখি শুধু।’
রাকা দেখে যাচ্ছিল এক বর্ষীয়ান কবি সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে কেমন প্রযুক্তিকে গ্রহণ করে নিয়েছে। তরুণ প্রজন্মের মত প্রবীণরাও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সড়গড় ভাবতে ভাবতে তার মোবাইলেও এক নোটিফিকেশনের কম্পন খেলে গেল। এর মধ্যে কখন যে মোবাইলটা হ্যান্ডব্যাগ থেকে হাতে চলে এসছে খেয়াল করেনি। দেখলো দিবাকরদা ইনবক্স করেছে তার গতকালের স্ট্যাটাসের বিষয়েসে বুঝতে পারল সত্তরোর্ধ দিবাকরদা কথা বলতে না পারলেও তার মন সচল। সেও উত্তরে লিখল- ‘যারা জড়িত ও ভুক্তভোগী তারা পড়বে না জানি। কিন্তু সেইসব মানুষের ভাগ্য যাদের হাতে তারা অথবা যাদের সমাজ আদর্শ বলে জানে, মানে তাদের তো দায় আছে এর বিরোধিতা করার অথবা এর থেকে সমাজকে বের করে আনার উপায় বাতলানো।’
-সেটাতো ঠিক,তাই বলে সব বিষয়ে অতিরিক্ত রি-অ্যাক্ট করাও উচিত নয়।
    - কিন্তু আজকের যুগেও এসব অনাচার মেনে নিতে হবে!
- হ্যাঁ আজকের যুগ বলেই এসব বেশি বেশি করে মেনে নিতে হবে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে শুধু মুষ্টিমেয় কিছু সৎ রাজনৈতিক ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের হাতেই সমাজের গতি প্রকৃতি নির্ভর করেনা। প্রতিটা মানুষ আজ মানসিক ভাবে স্বাধীন। নৈতিক শিক্ষার মূল্য তার কাছে ফিকে হয়ে যায় তার জীবনধারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অথবা তা পাবার জন্য লড়াইয়ের সামনে। সেই কারণে সমাজের নিজস্ব একটা বাজার তৈরি হয়েছে। সেই বাজারের নিয়মই নিয়ন্ত্রণ করে আজকের সমাজকে
    - কিন্তু সমাজে সঠিক রাজনৈতিক নীতি, আদর্শ বা সদর্থক ইচ্ছাশক্তি থাকবে না সেই বাজারের টুঁটি ধরে নিয়ন্ত্রণ করতে?
-না সেটা পারবে না কারণ রাজা চায় সেই বাজারের অংশীদার ও হর্তা-কর্তা হতে। তাতে তারও লাভ আর তার অনুগত প্রজাদেরও লাভ।
    - যে প্রজা তার অনুগত নয় তার কি হবে??
- হয়ত তাকে বিদ্রোহী হয়ে অন্য রাজার শরণ নিতে হবে, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে নয়তো সন্ন্যাসীর মত উদাসীন থাকতে হবে।
    -কিন্তু আজকের সমাজে যদি ধরে নিই কবিই সেই সন্ন্যাসীর ভূমিকা পালন করে তবে সেই কবি কি সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে পারে?
-আমি মনে করি কবির কাছে তার কবিতাই সব। কবিতা লেখাই তার প্রধান ধর্ম। কবিতাই তার কাছে চরম বাস্তব। বাকি সব অ্যাবস্ট্রাক্ট। সে ক্ষেত্রে সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে তার কিছু বলার থাকতেই পারেনা।
    - কেন থাকবে না ? কবিও তো সমাজের একজন। সমাজের প্রতি তার কোনও দায়বদ্ধতা নেই? সমাজের জন্য, মানুষের জন্য কোন নীতি কল্যাণকর আর কোন নীতি ঘাতক সে সম্পর্কে সে অবহিত থাকবে না।   
- এখনকার খুব কম কবিই পারে সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই সমাজের ভালোমন্দে জড়িয়ে পড়ে সে, কে ভালো রাজা আর কে মন্দ রাজা সেটা নির্ধারণ করার দায়ও এসে যায় তার উপরএটা একটা কবিদের ভালো দিক। সেটা আমি মানি।
    -কিন্তু সেটা বিচার করতে গিয়ে তারা পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়ে কেন? এটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়!  
- দেখ রাকা, সে তখন সমাজের বাইরের কেউ নয়। আর সবার মত তারও একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে পক্ষপাত আসতেই পারে, কিন্তু কবি কখনই পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারেনা। বৃহত্তর ও কল্যাণকর কোনও সামাজিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌছতে হলে তাকে কিন্তু শুধুমাত্র কিছু আবেগ,নীতি ও আদর্শের নিরিখে বিচার করলে হবে না। তাকেও সেই বাজারের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ কবি যে জনগণের কথা বলবেন, যে সমাজের হয়ে কথা বলবেন তারা অধিকাংশই বাজার নির্ভর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। আবার সেই জনগণের উপরই নির্ভর করছে রাজার নির্বাচন। তাই সেক্ষেত্রে কবির প্রধান হাতিয়ার যুক্তি ,বুদ্ধি আর বিবেক এর মেলবন্ধন।   
যুক্তি যুক্তি যুক্তি...... নিজমনেই বিড়বিড় করতে থাকে রাকাকেন এক এক ঘটনায় একেকরকম যুক্তি সাজায় বুদ্ধিমান লোকেরা, কেন সবক্ষেত্রে বিবেক কাজ করেনা তাদের?? এইসব ভাবতে ভাবতে আর কোনও টেক্সট করে না রাকাপ্রিয় কবির দিকে একবার চেয়ে বলল এখন আসি তবে দাদা। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন। কাল তো বায়প্সি রিপোর্টটা এসে যাবে মনে হয়, বিকেলের দিকে আমি একবার আসবো। এই বলে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে যায় রাকা
মোবাইলটা রেখে দিবাকর তার তরুণবয়সের কথাগুলো ভাবছিল। কবিতা লিখে বেশ নামডাক হয়ে গেছে ততদিনে। কিন্তু সেইসময়ে এক রাজনৈতিক আন্দোলনের হাওয়া বইছে দেশ ও রাজ্যজুড়ে। আর সমস্ত যুবকদের মত সেও প্রভাবিত হল সেই আন্দোলনের দ্বারা। সরাসরি না জড়ালেও তার লেখালেখির মধ্যে এক পরিবর্তন এসে গেল। একদিকে যেমন চলছে সশস্ত্র আন্দোলন ও সেই আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রীয় দমন। আর একদিকে তাদের মত কবিরা স্বপ্ন দেখছে কবিতা লিখে সমাজ ও দেশ পরিবর্তনের। রাকার মধ্যে যেরকম অস্থিরতা দেখতে পেল ঠিক একই অস্থিরতা তাদের মধ্যে ছিল তখন। একসময় সেই আন্দোলন রাষ্ট্রের কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হল। অবশ্য শেষের দিকে সেই আন্দোলন জনগণেরও সমর্থন পায়নিতবে সাহিত্যজগতে সেই প্রভাবটি অনেককাল পর্যন্ত বজায় ছিল।এরপর  বয়স যত প্রবীণের দিকে গেছে তত সে উপলব্ধি করেছে কবিতা যতটা না দশের , দেশের ততটাই একান্ত নিজস্ব মননের। কবিতা কোনও স্লোগান হতে পারে না , না কোনও উপদেশক্রমশ তার কবিতাগুলি একান্তই নিঃসঙ্গ উপলব্ধির অনুভূতিমালায় পরিণত হয়েছে। আজ সে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন।       
পরেরদিন হঠাৎ করে একটি পত্রিকা গোষ্ঠী দ্বারা আয়োজিত আলোচনাচক্রে তরুণ কবি হিসেবে আমন্ত্রিত থাকায় আর নার্সিংহোমে যাওয়া হয়নি রাকার। তার পরেরদিন গেল বিকেলের দিকে কেবিনে ঢুকে দেখল কবি লাগোয়া ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দিগন্তরেখার দিকে তাকিয়ে আছে। সকালেই কবিপুত্রকে ফোন করেছিল রাকা, প্রিয় কবির গলায় যে টিউমারটি অপেরেশন করে বের করা হয়েছে সেটি যে ম্যালিগন্যান্ট তা তখনই জেনে গেছিল সে। কবি চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছে দেখে রাকাও আর ডেকে তার নীরবতা ভঙ্গ করেনিকিছুক্ষণ পরে দিবাকর কেবিনে ফিরে আসে।
- আরে রাকা যে! কখন এলে, ডাকবে তো।
- দাদা আপনার কথা বলা বারণ আছে গলায় অসুবিধা হতে পারে, প্লীজ...
- আরে না না কিছু হবে না আমার। তুমি বল মনের অস্থিরতা কমেছে কিছু?
-হ্যাঁ ? ও! না, মানে সকালে দ্যোতন’দা কে ফোন করেছিলাম, ওই বলল আপনার রিপোর্টটি সম্বন্ধেআপনি কোনও দুশ্চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
-আচ্ছা এই ব্যাপার ধুত্‌ পাগল ওসব নিয়ে একদম ভাবছিনা মৃত্যুভয়...
- দাদা প্লীজ আপনি চুপ করে যান। কথা বলা বারণ আপনার।
-না রাকা আমাকে আজ বারণ করোনা । বলতে দাও ! অনেকদিন চুপ করে আছি ডাক্তারের পরামর্শে। কিন্তু আর থাকা যাচ্ছে না। আমার অসুখের নয় ঔষধ আছে, কিন্তু আমাদের সমাজে আজ ‘বাজার’ নামক যে ক্যান্স্যারের বীজ ছড়িয়ে পড়ছে তার নিরাময়ের উপায় কী? সেটা তোমাদের ভাবতেই হবে রাকাআমার বিশ্বাস তোমাদের মত বর্তমান তরুণরা বা আগামী প্রজন্ম নিশ্চয়ই বাজারের হাত থেকে সভ্যতা কে উদ্ধার করতে পারবে। বিশ্বায়নের যে বেসুরো গান বেজে চলেছে সভ্যতার বুকে তাকে এবার সাইলেন্ট মোডে আনতে হবে। নাহলে কবিতার প্রকৃত সুর ধরে রাখতে পারবে না সভ্যতা।
বলতে বলতে দিবাকর আবার ব্যালকনিতে চলে যায়। রাকা ও পিছু পিছু। কবি বলে চলেছে- আহা দেখ সূর্যের ছায়াটা কত মায়ামাখা । আদরের ছটা দিগন্ত জুড়ে! আমরা দেখছি যে সূর্য ডুবে যাচ্ছে...কিন্তু জানি যে পৃথিবী প্রকৃতই ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে! আবার এও বিশ্বাস যে আগামী কাল আবার আলোতে ভেসে উঠবে সে, তারপরেও সৃষ্টির ওমে নতুন করে সভ্যতার ভ্রূণ বিকশিত হবে।
রাকার দিকে ফিরে তাকায় কবি, চোখে এক নির্লিপ্ত ভাব - আজ সকালে দুটো লাইন লিখেছি অনেকদিন বাদে শোন-
“মানুষের সুখ নেই মানুষের দুঃখ নেই
আহ্‌ মরণ শুধু কাশফুলের মতন দোলে”
রাকা আর থাকতে পারেনা দুচোখ অশ্রুতে ভরে যায়।– আমি আসছি দাদা বলেই প্রায় ছুটে পালিয়ে আসে নার্সিংহোম থেকে। ঘরমুখো রাস্তাগুলি ভিড় করেছে ব্যস্ত রাস্তায়। ট্র্যাফিক জ্যামের কোলাহলের মধ্যেও শুনতে পেল মোবাইলের রিংটোন। কার ফোন না দেখেই জাস্ট সাইলেন্ট মোডে করে দিয়ে রাস্তার ভিড়ে মিশে গেল রাকা।
      




No comments:

Post a Comment