Sunday, June 3, 2018

গ্রন্থ -আলোচনা : রিমি মুৎসুদ্দি




‘লিখতে এসে নব্বইতে সবাই ব্লাডি ‘বেনে’!’(আমার পর যে লিখতে এসেছে তাকে): স্পষ্ট উচ্চারণ অথবা সরল বিষণ্ণতা

কবিতার জন্য কোন অনুভূতি অথবা লক্ষণই দুর্বল নয়। স্পষ্ট উচ্চারণে অকারণ জটিলতাবর্জিত নব্বইয়ের জনপ্রিয় ও বহুপরিচিত কবি অংশুমান করের কবিতায় কোন আরোপিত দর্শন নেই। চারপাশের জগত থেকে উঠে আসা কথায় কবির অনুভূতির মিশেল প্রকট হয়ে ওঠে তাঁর কবিতার ভাষায়। বইমেলা ২০১৮, ধানসিঁড়ি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত কবি অংশুমান করের স্বনির্বাচিত কবিতা সংকলন ‘স্বনির্বাচিত অংশুমান’। দুহাজারএক সালে ‘আপেল শহরের সম্রাট’ প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকেই তিনি বহু সচেতন পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং দুই দশক পেরিয়েও তাঁর কবিতা আজও পাঠকের মনে এক দীর্ঘস্থায়ী রেশ রেখে যায়।

‘স্বনির্বাচিত অংশুমান’ হয়তবা পাঠককে এক বা একাধিক বাস্তব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। নয়ের দশক থেকে ২০১৮- এই বৈচিত্র্যময় ও ঘটনাবহুল সময়ে মিশে থাকা নরম বিষণ্ণতা যেন অল্প আঁচে একটু একটু করে সিদ্ধ হতে থাকে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিকতা, নস্টালজিয়া, ভালবাসা, বিশ্বাস আর বিশ্বাসহীনতার দ্বন্দ্ব অথবা প্রোফেশনালিজম।
কবি এই বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন- ‘পড়া আর দেখা থেকে জন্ম নেয় আমার কবিতা। দেখা থেকে বেশি।’ এই বিশেষ দেখতে পারাটা কিন্তু একটা অসম্ভব চাপ। এটা যারা একটু আধটু এরকম দেখতে পান, তারা প্রত্যেকেই স্বীকার করবেন। এই বিশেষ দেখতে পারা ছাড়া অথবা বলা ভাল এই চাপ ছাড়া কবিতা বা কোন শিল্পই সৃষ্টি করা যায় না। তাই কবি বা শিল্পীর অন্ধত্বের অর্থ শিল্প বা কবিতার মৃত্যু।
‘Some sort of pressure must exist; the artist exists because the world is not perfect. Art would be useless if the world were perfect, as man wouldn’t look for harmony but simply live in it. Art is born out of an ill-designed world.’ Andrei Rublev, Solaris, The Mirror- ইত্যাদি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের নির্মাতা অ্যান্দ্রেয়ী তারকোভস্কির ভাষায় শিল্পের সংজ্ঞা ও শিল্পীর অস্তিত্ব। কবি নির্বাচিত এই কবিতা সংকলনেও একই অনুরণন যেন ধরা পড়ে। ‘পৃথিবী চ্যাপ্টা কমলালেবুর মতো ক্রমশ ফ্যাকাসে নিস্পৃহ হচ্ছে/আর চতুর্দিকে ডট্ কম ডট্ কম’(শিকার)- এ নিস্পৃহতাই কবিতার ভাবনায় কখনও ‘নীল পলিথিনের বৃষ্টিজল’(বৃষ্টি), কখনও বা অলীক কল্পনায় পাওয়া ‘আরব দেশের খাঁটি জিন’(রাজার ছেলে) অথবা চারপাশের পৃথিবীকে মানুষের ইচ্ছেয় পাল্টে যেতে দেখে মনে হওয়া- ‘ইঞ্চি মেপে, কালার বেছে/ ড্রয়িংরুমের মতো মহাকাশকেও উলটে পালটে নিই একটু’(আজ মঙ্গলবার)।
মহাকাশকে না ধরতে পারলেও সমগ্র ভারতকে কবিতার মধ্যে দিয়ে একই সূত্রে গাঁথার ভাবনা এই বইয়ের অন্যতম বিচরণ। যার প্রতিফলন পড়ে কখনো ‘উট্টাপম, দক্ষিণ ভারতীয় খাবার/ তুমি সবার থালায় কোভালামের বিচ ঢূকিয়ে দাও/সমুদ্রের শব্দ শুনতে শুনতে সবাই বুঝুক-/ দুনিয়া কী বিশাল, কত রং পৃথিবীর, কত মনখারাপ/ কত ঈর্ষা, আর ভালোবাসাও কত’(উট্টাপম) অথবা ‘যদি গড়বেতায় যাওয়া যায় একদিন/শান্ত-শীতল আলুদের সাথে একদিন/ কী আনন্দেই না কাটবে তাহলে’(আলু চাষ করে যে লোক)- এইসব অমোঘ পংতি ও কবিতা ভাবনায়।
‘আপেল শহরে সন্ধে নামবে অতঃপর/ ‘শুভরাত্রি ভাইসব এবার বিশ্রাম’ মালিদের এই কথা বলে/ ছোটো দু-কামরার খুপরি ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়বে/ একা আপেল শহরের সম্রাট’ (আপেল শহরের সম্রাট) অথবা ‘মাসল দেখিও না, ঈশ্বর, মাসল দেখিও না/ স্বপ্নে থেকো, কষ্ট থেকো/ মাসলে থেকো না (কে ঈশ্বর) – যেন কোন প্রোলেতারিয়েত নেতা বা লুম্পেন ঈশ্বরকে কখনও নিশ্চিন্তের ঘুম অথবা সাধারণ দুঃখ, কষ্ট ও স্বপ্নে বেঁধে রাখার প্রয়াস। এ কবিতা কোন রাজনৈতিক স্টেটমেন্ট নয়, আবার হতে পারে পাঠকের মাথার ভেতর সেঁধিয়ে যাওয়া ভাবনারা যা হয়ত কবির মতোই বলতে চায়, ‘আমরা যারা ‘ফালতু’, শুধু দু-চারপাতা লিখে/ স্বপ্ন দেখি পালটে দেব কালরাত্রিটিকে/ তারাই জেনো শেকড়, লাল মাটির নীচে থাকে/ ওপারে এই গাছ, তোমরা ‘দেশ’ বলছ যাকে’ (দেশ)।
এই নির্বাচিত কবিতা সংকলনের আরেকটা বড় পাওনা, ‘বাঁকুড়া পুরুলিয়া কলকাতা’ কবিতা সংকলনের কবিতাগুলো। এই কবিতাগুলোর রচনাকাল ২০০১ থেকে ২০০৩। সময়টা আপাতশান্ত হলেও বড়ো গোলমেলে। অথবা বলা ভাল একঘেঁয়ে। একই ঘুণধরা সংস্কৃতি, বাণিজ্যিক মশলায় ভরপুর বাংলা সিনেমা আর একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা আর ‘বসন্তের দুপুর, দুপুরের মন খারাপ,/ মন খারাপের বালি’ (কুবেরের বিষয়-আশয়) ছেড়ে ‘মানুষ চলেছে...... ‘নতুন ঠিকানা, নতুন বাসার আশা’ (বন্ধ কারখানার কবিতা)-য়, হয়ত বা একটু সুখের খোঁজে।
১৯৮৬ থেকে ২০০৩, মানুষে মানুষে জড়িয়ে মড়িয়ে থাকা থেকে মেট্রো সংস্কৃতির হাত ধরে একটু একটু করে একা হয়ে যাওয়া, অত্যন্ত প্রকট ও বাস্তবোচিতভাবে ফুটে ওঠে, কিছুটা নস্টালজিয়া আর অনেকটা বিষণ্ণতায় ভরা কবিতা ‘টেলিভিশন’-এ। ‘আসলে কী জানিস, ফাঁকা ঘর, তোরাও থাকিস না- ওই তো আমার একমাত্র বন্ধু- চললে মনে হয় একটা কেউ আছে, কথা বলছে- অন্তত, আমি একা না।’(টেলিভিশন) কী নিদারুণ সত্য আজকের ভার্চুয়াল পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা হয়ে যাওয়া মানুষের।
‘আমি কিন্তু ফিরে আসব আবার/হিসাব নিতে পুরোন সব দেনার’ (বিভাব কবিতা, নশো স্কোয়ার ফুটের জাদুকর) – এযেন অর্ধসমাপ্ত কোন বিপ্লবের কথা। শ্রেণীশত্রু যেখানে হয়তবা ‘মুখোশ’ অথবা ‘বনে বনান্তে চেনা বিছানায় চিরবসন্ত’ (বসন্ত) আর শ্রেণীসংগ্রাম বলতে হয়ত বুঝি ‘......কবিতা আর রুখে দাঁড়ানো একটা দুটো মানুষ।’ (প্রেমের কবিতা)
‘জেহাদি প্রেম’ তার আত্মবিশবাসের কাছে প্রশ্ন রাখে সত্যিই কি ‘এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি নীরা’ ? ‘নীরা’ অথবা সময়ের প্রেমহীনতা, গ্লোবালাইজড বিশ্বায়নের উন্নতির চাকায় তৃতীয় বিশ্বের অথবা উন্নয়নশীল দেশের মানুষের  দৈনন্দিন ভাল থাকা ও ভাল রাখার চাহিদা ক্রমশ যে পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়, সেদিকে পা রেখে কবি তাঁর অগ্রজ কবিকে বলতে চান, ‘আমি শুনতে চাইনি সুনীলদা, বিশ্বাস করুন,/ শুনতে চাইনি’ (নীরা)।
‘জলের মতো, মেঘের হাত ঘুরে’ (ফেরা) এ কবিতাগুলো ইমারত গড়ে না, কিন্তু কবি কন্ঠে উচ্চারিত হয়- ‘মাঠের প্রান্তে, গ্রামের শেষে, তাই লিন্টল পর্যন্ত উঠে থেমে যায় একটা বাড়ি, আমার কবিতা।’ (পরিত্যক্ত)


গ্রন্থ- স্বনির্বাচিত অংশুমান
প্রকাশক - ধানসিড়ি
প্রচ্ছদ সম্বিত বসু
মূল্য-২৫০টাকা

1 comment: