Sunday, June 3, 2018

নীরবতা এবং নীরবতাভঙ্গ: উভয় বিষয়েই কবি স্বেচ্ছাচারী: কস্তুরী সেন

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি






                                   নীরবতা এবং নীরবতাভঙ্গ: 
               উভয় বিষয়েই কবি স্বেচ্ছাচারী



শীর্ষনাম নিয়ে কথা শুরু করার ক্ষেত্রে প্রথম যা মনে আসে তা হল, কবি বলব কাকেসাহিত্যের মূলস্রোত, সমাজ বা গণমাধ্যমের দ্বারা স্বীকৃত কতিপয়কে কেবল, অথবা বৃহত্তর অর্থে তাঁদেরই বলব যাঁরা নিজের মধ্যে করে সৃজনের একটি তাগিদ বহন করে চলেছেন অহরহ, সংখ্যায়, স্বীকৃতিতে এবং প্রচারে তাঁদের সে সৃষ্টি, সে লেখাগুলি যদি পিছিয়ে থাকে তবুও তাগিদের বিচারেই, কবি তাঁরা জীবনানন্দ ধার করে বলতে গেলে এমন সকলেই, যাঁরাকারুবাসনা'র হেমের মতো বলবেন তাঁদের নষ্ট করেছেসবসময়েই সৃষ্টি করার আগ্রহ, তৃষ্ণা, পৃথিবীর সমস্ত সুখ-দুঃখ, লালসা, কলরব আড়ম্বরের ভিতর কল্পনা স্বপ্নচিন্তার দুশ্ছেদ্য অঙ্কুরের বোঝা বুকে বহন করে বেড়ানোর জন্মগত পাপ'
                                                              লালসা, কলরব, আড়ম্বরের ভিতর কল্পনা স্বপ্নচিন্তা কবিতার প্রধান প্রণোদনা যদি এইই হয়, কল্পনা স্বপ্নচিন্তা, তবে তার লালন কেমন করে? এই কল্পনা স্বপ্নচিন্তার ধারক হিসাবে একটি নির্জনতা প্রাপ্য তো হয়ই কবির, একটি তেমনই সজন নির্জনতা, যেখানে কলরব আড়ম্বরে কীর্ণ পরিপার্শ্বের মধ্যে তিনি হতে পারবেন আশ্চর্য একা একটি জগত তৈরি হবে তাঁর, সময়, চরিত্র, প্রেক্ষিত নির্বিশেষে যে জগতের রাশটি তাঁর এবং একমাত্র তাঁরই হাতে
                                                               ছায়া যদিও পড়বেই একটি গভীর পুকুর যদি ভাবি, জলের উপরিতলে চারপাশের বর্ণময়, ক্ষোভময়, সচল জীবনের অবধারিত প্রতিফলন এবং গভীরে, গভীরতর নিম্নমুখে সেই সমস্ত রঙ আলো রোদ ছায়া মিলেমিশে একটি সম্পূর্ণ আলাদা জগত, খুব সম্ভব তাকেই কি ব্যাখ্যা করা যায় না একটি সার্থক নির্মাণ বলে? শিল্পের যে কোন মাধ্যমেই?
                                                                এইখানে এসে একটি অনিবার্য প্রশ্ন জন্ম নেয় এই, যে, কবিতার ক্ষেত্রে শিল্পীর এই নিজস্ব নীরবতার বৃত্তসীমা কতদূর কোথায় এবং কখন এসে কবিকে তাঁর যোগাযোগের সুতোটি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে জলের ওই উপরিতলের দিকে বস্তুত কোথায় এবং কখনই বা নয় একজন মানুষ, যিনি কবিতা লেখেন, তাঁকে কবিতার বাইরেও একটি জীবন যাপন করতে হয়, পালন করার মতো ব্যক্তিগত সামাজিক নানা ভূমিকা রয়েছে তাঁর, এবং হয়ত এই বহিরঙ্গ, এইকলরবএর সঙ্গে আদৌ কোন বিরোধও নেই তাঁর অন্তর্গত নীরবতার
                                                                  বিরোধ আবার আছেও তবু কখন? তখন নয় যখন কবির ব্যক্তিজীবন তাঁর কাছে দাবি করছে কিছু ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা সাধারণ নিয়মেই খানিক বেশি যেহেতু ততক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক জীবনও নয়, যতক্ষণ সেই জীবনের তরফে কবির কাছেপ্রত্যাশা'ই থাকছে শুধু, ‘দাবি' বা বিস্তৃত অর্থে শাসন' নয় এইশাসন' শব্দটি ব্যবহার করলাম কেন? কবি বা শিল্পীর প্রতি সমাজেরশাসন' কি সম্ভব আদৌ? আপাত অর্থে অবশ্যই নয় এই শাসন, যা কবির প্রাপ্য নীরবতার প্রতিস্পর্ধী, তা আসলে আসে অন্য চেহারায় সেই চেহারার বিভিন্ন নাম কখনও সে নামনীতিবোধ', কখনও সে নামদায়বদ্ধতা', কখনও এমনই অন্য কিছু
                                                                  কবিতা বিষয় হিসেবে দ্বিমুখী তার একদিকে কবি স্বয়ং থাকেন, অপরপক্ষে অবশ্যই পাঠক উভয়ের মধ্যে একটি যোগাযোগ, একটি বোধগম্যতা,  একটি ব্যাখ্যা এবং একই সঙ্গে একটি রহস্যময়তা, একটি পরস্পরকে ছুঁতে না পারার, আংশিক বুঝতে পারার খেলা চলে অধিকাংশ সময়ে লেখার সময়ে আসলে যা ঘটে, কবির তরফে তা আত্ম-আবিষ্কারই একরকম, এবং সেই আবিষ্কারটিকে প্রকাশের স্পৃহাই খাতায় ফোটে কবিতা হয়ে এইটিই তাঁর মূল কাজ মাত্র হয়ত তাঁর জন্মসূত্রে নির্ধারিত একমাত্র কাজও এবং এই জায়গায় ব্যক্তি কবি স্বেচ্ছাচারী যতদূর,  ব্যক্তি পাঠকও ঠিক ততটাই তাঁদের এই দায়হীন নীরব জোগান চাহিদার মধ্যে যোগ ঘটানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব টি পালন করে কবিতাটি স্বয়ংযে লেখা যত সার্থকভাবে এটি করতে পারে সৃষ্টিকাজ হিসেবে সেটি তত সফল কবির তরফে লেখাটি পাঠকেরউদ্দেশে' হতে পারে এই যা, কিন্তু তারউদ্দেশ্য' পাঠকের গ্রহণ বা বর্জন  কোনটাই নয় দুটিই পাঠক করেন নিজের ইচ্ছেয় আর পাঠকের সেই ইচ্ছের কথা মাথায় রেখে যদি কবি লিখতে বসেন, তবে সে লেখা হয়ে দাঁড়ায় পণ্য শ্লোগান বা ইশতেহারও হয়ত, কিন্তু স্বয়ংসিদ্ধ সার্থক একটি কবিতা কখনওই নয়
                                                                        সমস্যা এখানেই, যে ব্যক্তিপাঠকের বদলে সমষ্টির কাছ থেকে এই শ্লোগান, ইশতেহার বা নিছক বক্তব্যেরও দাবি আসে বই কি সময়ে সময়ে দাবি আসে কবির নিজস্ব নীরবতাটি ভঙ্গ করারও সমষ্টি বা সমাজপ্রত্যাশা' নয়, ‘দাবি' করে সে ঠিক করে দেবে কবিতার বিষয়, সে ঠিক করে দেবে দুর্ভিক্ষ বা রাষ্ট্রবিপ্লবে কবির ভূমিকাটিও বহুদূরই তার দাবি তৈরি হয় বিষয়বিশেষে অন্তর্গত নীরবতার গণ্ডি ভেঙে কখন লিখবেন কবি, এমনকি বলবেনও কখন, কী বলবেন, কীভাবে বলবেন, কোন পক্ষে বলবেন, কীসের বিপক্ষে বলবেন, উচিত কী তাঁর, অনুচিতই বা কী, সেসবও
                                                                      এবং এখানেই, যখন একজন কবি তাঁর ইচ্ছা অনু্যায়ী সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম, হ্যাঁ অবশ্যই সে সিদ্ধান্ত হতে পারে জনমতেরই পক্ষেও এমনকি; কিন্তু অক্ষম, বৃহত্তর অর্থে অবশ্যই অক্ষম বিষয় বাছতে, একটি বিষয়ে স্বেচ্ছায় বলে অন্যটি সম্পর্কে স্বেচ্ছায় চুপ থাকতে, তখনই, যাকে শুরুতেই জীবনানন্দ অনুসরণে বলা গিয়েছিল কল্পনা স্বপ্নচিন্তার অধিকার, সেই সূত্রে অমোঘ নীরবতারও, তা নষ্ট হয় পুরোপুরি এবং পাঠক বা সমাজের মুখাপেক্ষী হতে গিয়ে শিল্পের স্বাধীনতার সঙ্গে আপোষ যদি করার ক্ষেত্র তৈরি হয় তবে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে একটি প্রকৃত কবিতার ব্যহত হয় শিল্পের মূল লক্ষ্য আত্ম-আবিষ্কার বা আত্মপ্রকাশের বিষয়টি, বুদ্ধদেব বসু যেমন লিখছেন তাঁরশিল্পীর স্বাধীনতা' প্রবন্ধে এই বলে যেএই আত্ম-আবিষ্কার, আত্মপ্রকাশের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়াটি যতক্ষণ চলতে থাকে জীবন ভরেই চলা উচিত ততক্ষণ বাইরের কোন শাসন শিল্পীর ওপর প্রযোজ্য নয়, এই কাজের যা অন্তর্গত নয় এমন কোন দাবি তাঁর ওপর করা চলবে না, এই দায়িত্ব একাই যথেষ্ট গুরুভার।‘
                                কবির নীরবতা আসলেই, তাঁর অধিকার এক অর্থে, অন্তত যতক্ষণ তাঁর সৃষ্টির প্রতি তিনি সৎ নীরবতা এবং নীরবতাভঙ্গ, উভয় বিষয়েই স্বেচ্ছাচারী তাই হতেই হবে তাঁকে শুধুমাত্র দিনানুদৈনিকে নয়, পরিস্থিতিনির্বিশেষে প্রবল প্রত্যাশা প্রতিক্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়েও এমনকি, প্রয়োজনে নিজের বাহ্যিক imageকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই তিনি কবিতা অর্থে লিখবেন সেটুকুই যেটুকু তাঁর নিজের বলার কবিতার বাইরে আর যা কিছু দায়বদ্ধতা, আমরা বাকিরাও জানব সেটুকু তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা করা চলে মাত্র, দাবি করা নয় নীতিবোধ বা নীতিবোধহীনতা, ঔচিত্য বা অনৌচিত্য যদি কাঠগড়ায় কাউকে দাঁড় করাতে পারেও, তা পারে ব্যক্তিমানুষকে ব্যক্তিমানুষের গণ্ডিটি পার হলে শুরু সেই আশ্চর্য নির্জন জগতের যেখানে সদাচারী বা দুরাচারী, ঈশ্বর বা শয়তান, দায়বদ্ধ বা স্বেচ্ছাচারী একজন মানুষ একটি জাদুর প্রদীপ হাতে হেঁটে যান সে প্রদীপের শব্দই আলো, আর সে আলোয় আলোয় তৈরি হয় অপূর্ব ইন্দ্রজাল এক, যার আরেক নাম কবিতা
                                এবং কবিতাই মাত্র তার অধিক কিছু নয় তার অধিকে যে সদসৎ, তার অধিকে যে ঠিকভুল, ‘কবি' হয়ত শেষ পর্যন্ত একমাত্র তিনিই, সেই সদসৎ ঠিকভুলের প্রতিভূ হওয়ায় যাঁর চিরদিনের অনধিকার

3 comments:

  1. গভীর। সুন্দর।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ অনেক।

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর। কিন্তু কবিরা কি এই শিল্পের স্বেচ্ছাচারের সুযোগসন্ধানী ব্যবহার বেশি করেন না? আলোচনার ইচ্ছে রইল।

    ReplyDelete