ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি
যে বিবেকের স্বর
গাঢ় অন্ধকারেও আলোকবর্তিকা
যে বিবেকের স্বর
গাঢ় অন্ধকারেও আলোকবর্তিকা
ভিড় বাস। পাটা বিশ্রীভাবে মাড়িয়ে
দিল। একটু জোরেই আঃ করে উঠল অতীন। খুব ইচ্ছে করছিল চারটে কথা শুনিয়ে দেয়। না থাক্।
সেই তো এক কথা, ' অসুবিধে হলে ট্যাক্সিতে চলে যান দাদা।' রাগটা গেল না। বাড়ি ফিরে প্রথমেই টিভিটা অফ করলো।
সোমার দিকে তাকালো, পাড়ার লোক জানিয়ে টিভি দেখতে হবে?
কোথায়? আস্তেই তো ছিল!
তর্ক করো না।
সোমা বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরে ফেসবুক
করছে।
অফিস থেকে ফিরে অতীন স্নান করে।
প্রতিদিনের অভ্যেস। আজও করলো। রাগটা এখনও যায়নি। নাহ্, এখনই লিখতে হবে। অতীন লিখছে।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল ভ্রু, কপালের ভাঁজ।
নতুন কবিতা লিখলে, সোমাই হয় অতীনের প্রথম শ্রোতা।
সোমা, দশটা পাঁচটার চাকরীটা করতে
আর ভালো লাগছে না-
হুঁ। করতে তো হবে, তাই না? আর
সারাদিন ঘরে বসে কি শুধু কবিতা লেখা যায়?
অ্যাশট্রেটার দিকে স্থির তাকিয়ে
আছে অতীন। নিজের মনে হাসে। একটা কবিতা লিখতে আর কতটুকু সময় লাগে। কিন্তু তার অবয়ব? কখন স্পষ্ট হবে তার কি কোন হদিস আছে অতীনের কাছে! দেশ বিদেশের এত এত কবি, তাদের কবিতা! অতীন চায় গোটা
পৃথিবীর কবিতাকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসতে। ইচ্ছে করে কবিতার শান্ত সরোবরে- ওই শীতল জলে
গা ডুবিয়ে থাকে দিনভর। কিছুতেই মন বসাতে পারে না অফিসের কাজে। হিসেব নিকেশের কাগজ জানলা
দিয়ে উড়ে যেতে চায়।
সোমা চায়ের কাপটা নিয়ে যেতে যেতে
ভাবে, আর বড় জোর ছ মাস। স্কুলের চাকরীটা হয়ে গেলেই অতীনকে বলবে ছেড়ে দিতে। তারপর ছেলেটা
যতখুশি লিখুক গে।
সবজি মাছ, এসব বাজার করতে অতীনের ভালোই লাগে।
টাটকা লালশাক, কচি পটল, গাঢ় কুমড়োর ফালি, অতীন মুগ্ধ চোখে দেখে। চারপাশের হৈচৈ হাসিঠাট্টা
অকারণ কথা- খারাপ লাগে না কিন্তু। নিজে বাছাবাছি করে না। ওটা এক কিলো, এটা আড়াই শো,
ওটা পাঁচশো দাও তো। সবজিওয়ালির ফিচেল হাসি, বাচালতা, ওজন করার ভঙ্গিমা, স্বতঃস্ফূর্ত
শরীরের ভরা জোয়ার- অতীনের চোখে কবিতা হয়ে ধরা দেয়। দুচার টাকা হয়ত ফেরত নিতেও ভুলে
যায়। আলুর বস্তাটা এমন গায়ের কাছে এনে ফেললো, লাল হয়ে গেল পাঞ্জাবির সামনেটা। আজই ভেঙেছিল।
একটু সরে দাঁড়ালো। কই রাগ হলো না তো! ওই কোনের দিকের বুড়ি এঁচোড় মোচা থোর নিয়ে বসে।
সোমা কাটতে পারে না। তবু বুড়ি জোর করে দেবে। দেখতে পেয়েই চিৎকার শুরু করেছে। নেবো না
নেবো না ভাবতে ভাবতেও অতীন একটা এঁচড় নিলো। অথচ অফিসে কি বিরক্তি লাগে! সারাক্ষণ দরকারি
কথা, মেপে কথা, আড়ালে কথা। তার ওপর যেহেতু একটু আধটু লেখে, কাগজে টাগজে বেরোয়, দু এক
বার টিভিতে টক শোয়ে ডাক পেয়েছে তাই যেন আরো বিড়ম্বনা। একটু ফাঁক পেলেই ওর চারপাশে সবাই
এসে জরো হয়। তারপর কী ভীষণ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা! আর যখন পারে না, দমবন্ধ হয়ে আসে, একতলায়
নেমে দারোয়ানের টুলে ভাগাভাগি করে বসে। আয়েশ করে জর্দা দেওয়া পান খায়। ওই যে, যখন নোটবন্দি
হলো, সবাই এক একজন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হয়ে উঠলো! সেটা অবশ্য খারাপ নয়। দশ, দেশ,
দেশপ্রেম, তার অর্থনীতি, তার ডিজিটাল ভবিষ্যৎ
নিয়ে একটু হলেও লোকজন মাথা ঘামিয়েছে। অতীন খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করতো ওদের অভিব্যক্তি, শরীরী ভাষা, মুখের রেখার পরিবর্তন। সে সময় খুব অসহায় লেগেছিল। রাতারাতি এমন একটা সিদ্ধান্ত!
যা একটা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে! সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে এই আলোচনাগুলো
তখন ওর বড্ড মেকি মনে হত। দেশের বাড়ি থেকে বাবা ফোনে জানিয়েছিল, সত্তর আশিটা ছেলে বরোদা
থেকে কাজ হারিয়ে ফিরে এসেছে। ওখানে সোনার কাজে গেছিলো, সেই কোন ছোটবয়সে। অনেককেই অতীন
চেনে। ওদের নিয়ে কোন কবিতা লেখেনি। ইচ্ছে করেনি। আজ বছর পেরিয়ে গেছে, এখনও ওরা কাজ
জোটাতে পারেনি। ঘরে বউ বাচ্চা বাবা মা।
অতীনের কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে না। লেখা
প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। মনটা সারাক্ষণ তেতো হয়ে থাকে। সেদিন অফিসের ক্যান্টিনে আসিফাকে
নিয়ে যখন রগরগে আলোচনা চলছে, অতীনের গাটা গুলিয়ে উঠেছিল। একদল চেঁচাচ্ছে আসিফার ধর্ম
নিয়ে কেন কথা তোলা হচ্ছে। একটা বাচ্চা মেয়েকে গণধর্ষণ করা হয়েছে এবং কীভাবে করা হয়েছে
সেটাই আসল কথা। আর একদল গলার শিরা ফুলিয়ে বলছে, এরমধ্যে ব্যক্তিগত যৌন খিদে থাকলেও,
সঙ্গে ধর্মের সুরসুরিও আছে। অতীন মাথা নীচু করে পরোটার টুকরোর ভিতর আলুর তরকারি পোরে।
জল দিয়ে গিলতে গিলতে ভাবে, নির্ভয়া কাণ্ডের সঙ্গে আসিফা কাণ্ডকে কিভাবে গুলিয়ে ফেলা
সম্ভব! কিভাবে একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র যৌন উত্তেজনার উপাদান হয়ে উঠছে! ক্লান্ত শরীরে
সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরলো। ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে ধর্ষণের নিঁখুত বিবরন দেওয়া কবিতাগুলো স্ক্রল
করতে থাকে। মাথাটা আবার ঝিমঝিম করছে। বাথরুমে গিয়ে হরহর করে বমি করে ফেলে। সারারাত
এপাশ ওপাশ করে। যতবার বাচ্চা মেয়েটার চোখ দুটো ভেসে উঠেছে, অতীন চলে গেছে সেই পাহাড়
ঘেরা উপত্যকায়। ধবধবে একটা টাট্টু ঘোড়ার ওপর বসে আছে ছোট্ট আসিফা। ঘোড়াটা লাফাতে লাফাতে
এগিয়ে আসছে অতীনের দিকে। ঘন চোখে আসিফা দু হাত বাড়িয়ে আছে।
অতীন আর এখন নির্বিকার থাকতে পারে না।
ছোটখাটো বিষয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলে। সোমা ওর দিকে অবাক চোখে তাকায়। বুঝতে পারে, একটু
একটু করে পালটে যাচ্ছে অতীন। জন্ম থেকে যেখানে বড় হল, সেই জল হাওয়া রোদ আর মানুষকে
আজকাল বড্ড অচেনা লাগে। দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এলো। বাবা চিরকালের
আদর্শবাদী মানুষ। তার ধ্যানধারনা ভাবনায় কখনও চির খায়নি। যে মতবাদ পৃথিবীর বুক থেকে
প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও, তিনি বিশ্বস্ত প্রহরীর মতো দাঁড়িয়েছিলেন একা। ছোটকা ফোনে
জানালো- বাবা যখন ভোট দিতে যাচ্ছিলেন, দুটো গুলি এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়ে যায়। মোবাইলটা
হাত থেকে পড়ে গেল। অতীন বইয়ের আলমারির কোণায় কুঁকড়ে বসে আছে। চোখে জলের ধারা। স্পষ্ট
দেখতে পাচ্ছে- প্রকাশ্য দিবালোকে, রাজপথে, রক্তস্নান করছে বাবা!
অতীন কোনকালেই শ্রাদ্ধ শান্তিতে বিশ্বাস
করেনি। সাদা চাদরে ঢাকা বাবার পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে মন্ত্রোচ্চারণ করে-"............................
মানুষ বড় একলা, তুমি তাহার পাশে
এসে দাঁড়াও,
এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও এবং ভালোবেসে
দাঁড়াও
মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে
পাশে দাঁড়াও।"
অতীন আর গ্রামের বাড়িতে ঢোকেনি।
ওই গাড়িতেই ফিরে আসে কলকাতা। সারাটা পথ চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করতে থাকে-
"..........
.................................................................................
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।"
অতীনের আবার লিখতে ইচ্ছে করছে।
খুব ইচ্ছে করছে। অন্তত একটা কবিতা। যে বিবেকের স্বর গাঢ় অন্ধকারেও আলোকবর্তিকার মতো
জেগে থাকবে, জাগিয়ে রাখবে- এমন একটা কবিতা।
No comments:
Post a Comment