Sunday, June 3, 2018

কবির নীরবতাই কাম্য: প্রসূন মজুমদার

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি





                      কবির নীরবতাই কাম্য


    এখন,যখন এই লেখাটা লিখতে শুরু করছি, ঠিক তার আগের দিন ছিল নজরুলের জন্মদিন।তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের যেকোনো বই খুলে দেখুন, তিনি কবি হিসেবে সন্দেহের তিলক পরে আছেন।আমিও তাঁকে অস্বীকার করি না,কিন্তু মহৎ কবি বলে মনে করি না। অবশ্য বাংলাদেশ কেন মনে করে তা আমি জানি না। আমি কেন নজরুলকে দিয়ে এই লেখা শুরু করলাম? মনে হল নজরুলের উদাহরণ দিলে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে। নজরুল যে লেখাটা লিখেছেন সেখানে বেশিরভাগ বা প্রায় সব সময়েই চড়া স্বর ঝমঝমিয়ে উঠেছে।সেটাকে যদি কবিতা বলতে হয় তবে নির্বাচনী দেওয়াল লিখনকেও কবিতা বলতে হবে। কিন্তু আমরা জানি যে দেওয়াল- লিখন কবিতা না। এই সর্বজন - স্বীকৃত ধারণাটাই বলে দেয় যে, কবিতায় উচ্চকিত ভাবের বিচ্ছুরণ কাম্য নয়।কবিতা আসলে শব্দ-নির্মিত নৈঃশব্দ্যই, শেষপর্যন্ত।  কবিতার যে যাত্রাপথ, সেটা রহস্যঘন, কুয়াশাচ্ছন্ন নৈর্ব্যক্তিকতার দিকে যাত্রা। সুতরাং কবির সাধনা সব সময়ই নিজেকে কঠোর অনুশাসনে বুঝিয়ে চলা --- ' চুপ করো, শব্দহীন হও'।
     পাঠক নিশ্চয় এই উদ্ধৃতির কবির সঙ্গে পরিচিত? এবং তিনি নিশ্চয় এতক্ষণে একটু নড়েচড়ে বসেছেন।কারণ যিনি এই কথা লিখে বসে আছেন সেই কবির কবিতা- অভিপ্রায় খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে যে তিনি ঠিক তাঁর/জাতির দরকারি মুহূর্তে কবিতায় সরব হয়েছেন।তাঁর কবিতা- অভিপ্রায়ের পিভট মনে হতেই পারে কবি বিষ্ণু দে-র সেই বাণী --- 'সংবাদ মূলত কাব্য'। রাম বলতে বলতে যেমন মরা হয়ে যায় তেমনি সংবাদ কাব্য বলতে বলতে একদিন কাব্যই সংবাদ হয়ে গেছে। কবি শঙ্খ ঘোষ সমাজের বিবেক হয়ে ওঠার তাড়নায়, এই  খণ্ডসত্য,বিশেষ করে একেবারে স্থানীয় রাজনৈতিক বা সামাজিক ইস্যুগুলো নিয়ে লিখে চলেছেন,হাততালি পড়ছে,আর এই ক্ল্যাপের মোহ এত ব্যাপক যে পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকের খ্যাতি-হাঘরে কবিদল একই কৌশলে পত্রিকা,বই,ফেসবুকে দাপাচ্ছে। তারা শঙখবাবুর নৈঃশব্দ্য -এর কবিতাগুলোর দিকে তাকায় নি।তাই কবিতা তাদের দিকে তাকিয়ে দূরে বসে খিল্লি করছে আর নির্জনে বিড়ি ফুঁকছে কিনা বলা যায় না।

  এই পরিস্থিতিতে সাধারণ পাঠক কবিতা বলে যে মালটা পেয়েছে,পড়েছে আর হাততালি দিয়েছে তার বেশিরভাগটাই সে পেয়েছে আবৃত্তিকারদের কম্পিতকণ্ঠে। সেসব কবিতার সঙ্গে আবার নানা - বাদ্যের ধ্বনি উঠেছে। 'ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত' থেকে 'বেণী মাধব' কিম্বা 'শাড়ি' মঞ্চসফল শব্দবৃত্তে কবিতার বস্ত্রহরণ করে ছেড়েছে।এই ধ্যাষ্টামোকে কে ঠেকায়! যে কবিতার উদ্দেশ্য নীরবতার দিকে যাত্রা, তাকে পিঁপড়ের মতো পিষে মেরে সশব্দ আস্ফালন চলেছে।  কারণ লোকে তাতে হাততালি দিচ্ছে। কবিতা নিয়ে ওইভাবে স্বরকম্পিত চিৎকার না করে যদি কবিয়ালদের আনা যেত?  কিম্বা যদি খেউড়, খ্যামটা, আখড়াই,চলতো?নিদেনপক্ষে যদি ডি,জে বাপন আসতো, তাহলে অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়া যেত,কিন্তু তাদের আনলে যথেষ্ট বুদ্ধিজীবী হওয়া যেত না, তাই বাচিক -তোষণ।  যাই হোক এই বাচিকদের দ্বারা কবিতার জনপ্রিয়তা বাড়বে টাইপের তত্ত্ব যারা আওড়ায় তারা নিজেও জানে যে কবিতার না,কিছু কিছু লোকের এতে নামযশ হয়,অর্থ/ক্ষমতা কিঞ্চিৎ হলেও লাভ হয়।কবিতার আখেরে ক্ষতি হয়।কারণ কবিতা নীরবে থাকতে পছন্দ করে।যে মেয়ে নীরবতার সাধনা করতে চায়,তাকে ভরা সভায় খ্যামটা নাচালে তার যেমন অবস্থা হয় কবিতা তেমনই এইসব সচকিত উত্তেজনায় থেঁতলে গিয়ে আবার নিজের অন্ধকার কুয়াশা-কোটরে গুটুলি পাকিয়ে থাকে অপেক্ষায়।কোনোদিন কেউ নীরব শান্ত পায়ে এসে হাওয়ার শিস দিতে দিতে জাগিয়ে তুলবে তার ফণা, আর সে ফণা শূন্যে ছোবল মেরে ফাটিয়ে দেবে সত্যের তুলোবীজ,কবিতার তুলো উড়বে মেধার গোপনে, এই তার স্বপ্ন,এই তার স্বাদ।

     সামাজিক দায় কবিতার আছে কিনা এ নিয়ে চাপান-উতোর বহুদিনের। কিন্তু মজা হল সামাজিকতা আর কবিতা এক বিন্দুতে দাঁড়ালে সেটা সামান্য অংশকে আলোকিত করে মাত্র। শিল্পের দায় এই ছোট্ট কুয়োকে দেখানো না,সেখানে 'অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ পড়ে আছে'। অনন্ত কুয়োয় নামতে নামতে অকস্মাৎ লাফ দিয়ে অন্তহীন আকাশে মিশে যেতে পারাই কবিতার দায়। শব্দ যদি ব্রহ্মস্বরূপ,তবে শব্দ আসলে অনন্ত সম্ভাবনাময়। শব্দের সবচেয়ে কঠিন সম্ভবনা হলো নৈঃশব্দ্য সৃষ্টি। কবি শব্দকে নৈঃশব্দ্য-এ নিয়ে যান। এটাই তাঁর সাধনা। তাই কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব নীরবতায়।

   আমি জানি কেউ এক্ষুনি প্লেখানভের তত্ত্ব বলবেন,কেউ বলবেন চারনিসেভস্কির কথা। কিন্তু আমি জানি রিলকেকে,আমি জানি জীবনানন্দ, আমি জানি হ্যেল্ডার্লিন,আমি জানি রবীন্দ্রনাথ। তাই আমি আমার কথা বলবো।আমি বলবো কবিকে ভূয়োদর্শিতায় উত্তীর্ণ হতে হবে।ঈশ্বর আর শয়তান একই সঙ্গে তার দুই কাঁধে ভর করে থাকবে। তাকে অমৃতের নীরবতায় মিশে থাকতে হবে,গরলের নীল বিষে স্তব্ধ যন্ত্রণায় নিবিড় নিঃশব্দ থাকতে হবে।আপনারা যারা জানেন,রিলকের সারারাত জেগে একটা ফুলের পাপড়ির উন্মোচন দেখার কথা তারা নিশ্চয় ছুঁতে পারবেন শব্দকল্পদ্রুমের 'ফুল ফোটে তাই বলো আমি ভাবি পটকা'র ইমেজারি।নৈঃশব্দ্য-এর ওই তীব্র সম্মোহন কবির উদ্দিষ্ট। আপনি নিশ্চয় জানেন রাতের পথে হেঁটে যেতে যেতে জীবনানন্দের গাছের দিকে গাছেরই ডাল ছুঁড়ে হঠাৎ পাখিদের সমবেত জেগে ওঠার ধ্বনি শুনতে চাওয়ার আর্তি।কবি ওই নৈঃশব্দ্য -এর মধ্যেই শব্দের সাধনা করেন।এই জীবনানন্দকে চট করে বুঝে ফেলা সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর কম্ম ছিল না।কারণ তিনি তখন লিখছেন,'কমরেড  আজ নবযুগ আনবে না ' টাইপের স্লোগান। তিনি ওই চারনিসভস্কি কিম্বা লুয়ানচার্স্কির তত্ত্বে আচ্ছন্ন তখন।অথচ তিনিই একদিন এসে লিখবেন,'তারপর সেই রাক্ষুসীই আমাকে খেলো'। নীরবতার কাছে কবিকে ফিরতেই হবে শেষপর্যন্ত। গাইতেই হবে 'স্তব্ধতার গান'। 

  এখন প্রশ্ন হল কবি নিজে কি নীরবতার মধ্যে থাকবেন?একথায় কেউ নিশ্চয় বলবে কবি তো মানুষ, সেও তো সামাজিক জীব।বলা চলে স্পর্শকাতর,উন্নত মেধাবৃত্তির মানুষ।তবে তিনি কি সমাজের সঙ্কটকালে সরব হবেন না?আমি ব্যাপারটা নিয়ে একটু অন্যভাবেই ভেবেছি।কবি কি সত্যিই সামাজিক? নিশ্চয় সামাজিক।তবে সমাজের প্রচলিত অনুশাসনে তিনি বন্দী নন।তিনি মুক্ত। তাঁর নিজস্ব দেখার চোখ তাঁকে সমাজের অদরকারি অনুশাসন থেকে সরিয়ে নিয়েছে।তাই সমাজের প্রচলিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে তিনি জগত ও জীবনকে নির্মোহভাবে দেখেছেন।সমাজ যখন  আবেগে উত্তাল কবি সেই আবেগের শরিক নাও হতে পারেন। এমন স্তব্ধতা কখনো কবিকে সমাজের চোখে সন্দেহযোগ্য করে তুলতে পারে।কিন্তু কবিকে অবশ্যই স্বাধীনতা দিতে হবে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশে। সমাজের সব অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই তাঁর একমাত্র কাজ নয়। তাঁর খোঁজ আরও ব্যাপক। কবি কোন সমাজকর্মী নন। তিনি অবশ্যই স্বপ্ন দেখছেন মহত্তর সমাজনির্মাণের কিন্তু সেটা সমাজের ছোট ছোট আন্দোলনের তালে পা মিলিয়ে তিনি নিয়ে আসতে চাইবেন, এমন নাও হতে পারে। 
  তাই কবিকে সামাজিক ক্রিয়ায় নামিয়ে না এনে বরং বৃহত্তর চিন্তাজগতের নেতা হিসেবে দেখাই ভালো।কবির নীরবতাই শেষাবধি আমার কাম্য। অক্ষরের কাছেই একমাত্র তিনি দায়বদ্ধ থাকুন। কবিতা তাঁর পথ চেয়ে আছে।


No comments:

Post a Comment