Sunday, June 3, 2018

কবির নীরবতা, কবিতার দায় : দেবব্রত শ্যাম রায়


ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি








                                            কবির নীরবতা, কবিতার দায় 


আজ থেকে প্রায় দু'দশক আগে এক শারদসন্ধ্যায় ঠাকুরনগর স্টেশনে বসেছিলাম। শিমুলপুরে কবি বিনয় মজুমদারের বাসগৃহে সারাদিন কাটিয়ে তখন আমরা বাড়ি ফেরার পথে। কবিকে ঘিরে কবির জন্মদিন পালনের এক অনাড়ম্বর কিন্তু অত্যন্ত আন্তরিক আয়োজন করেছিলেন  'নৌকা' পত্রিকার সম্পাদক অমলেন্দুদা। কবি মৃদুল দাশগুপ্তের বুদ্ধিদীপ্ত আড্ডা-রসিকতায় ডাউন ট্রেনের জন্য অপেক্ষার ভার লাঘব হচ্ছিল , তাঁকে ঘিরে একগুচ্ছ নবীন কবির দল। হংসমধ্যে বক যথা সদ্যতরুণ আমিও উপভোগ করছিলাম সেই আড্ডা। কথাপ্রসঙ্গে এক নবীন কবি সপ্রতিভ স্বরে বলে উঠলেন- 'আচ্ছা, যদি গদ্য লিখে যদি কেরিয়ার করা যায়, কবিতা লিখে কেরিয়ার করা যাবে না কেন? কবি মানেই অপুষ্টিতে ভোগা বেকার রুগ্ন একটা লোক- তা কেন ? আমি কিন্তু কবিতা লিখে সিরিয়াসলি কেরিয়ার করার জন্যই এসেছি।' আমি ভাবছিলাম, হয়তো বা ভুল করেই, বিনয় মজুমদারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে, তাঁর মতো মহাকবির অবস্থা চোখের সামনে দেখেও, একথা বলার সাহস কারও হয় কীকরে? অসম্মত হয়েছিলেন কবি অজয় নাগ। মৃদু স্নেহের সুরেই বলেছিলেন, হুবহু এক না হলেও এমনটাই-  'কেরিয়ারের সঙ্গে কবিতাকে জোড়া যায় না। কেরিয়ার করার জন্য কবিতা লিখলে, কবিতা আর কবিতা থাকবে না রে।'

ট্রেন এসে যাওয়ায় সেদিন সেই তর্কের মীমাংসা হয়নি। সময় অবশ্য আজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছে। কবিতার শৈলী ভালোভাবে জানা থাকলে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে কবিতা লিখে 'কেরিয়ার' করা সম্ভব। কেরিয়ারের আনুষঙ্গিক হিসেবে জুটে যাবে সভাকবির অলিখিত মর্যাদা, রাজ্য জোড়া বিভিন্ন বইমেলায় ও অনুষ্ঠানে উদ্বোধন ও কবিতাপাঠের অনুরোধ, সকাল থেকে সন্ধ্যা স্তাবকবৃন্দের কোলাহল, সভা-সমিতি-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বক্তৃতাদানের ডাক, এমনকি কেরিয়ারের উচ্চপর্যায়ে সরকারি খরচে বিদেশভ্রমণ। শুধু কবিকে জানতে হবে শব্দ ও শুভ্র নীরবতার কুশলী ব্যবহার। কবি তো জানেনই, কবির কাজই তো তাই, শব্দের মাঝে মাঝে নীরবতা বুনে দেওয়া, আর নীরবতার মধ্যে শব্দ। বদলের হাওয়ায় পুরোন শাসকের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত কবির শব্দই একদিন তাঁকে নতুন শাসকের চেয়ারের পাশে এনে বসিয়ে দেবে, পুরোন সভাকবিকে স্থানচ্যুত করে নবান্নে আসন পাতা হবে তাঁর। এরপরই চোখ বন্ধ করে নিশ্চিন্তে ডুবে যাওয়া যেতে পারে অনন্ত নীরবতার সাধনায়। প্রশ্ন হল,  এইসব কবিতা-লেখকদের নিয়ে আমরা এত সময় ও শব্দ খরচ করব কেন? এইখানে এসে একটু থমকাতে হচ্ছে। 'সুবিধেবাদী' শব্দটার ব্যবহার সাধারণীকরণ হয়ে যাবে কি? বস্তুত, যেকোনও নিদানেরই মধ্যেই একটা সরলীকরণের ফাঁদ আছে, এটারও। তথাকথিত শিবির বদল তো সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও করেছিলেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, যাঁর পায়ের পাতার ওপরেও দু'টি চোখ ছিল, মানুষের জীবন ও সংগ্রামকে যিনি মাটির কাছে থেকে দেখেছেন, সারাজীবন বামপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাস করেও এই মানুষটি শেষ জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। হতেই পারেন। তাই বলে আদর্শগতভাবে সম্পূর্ণ  দেউলিয়া একটি দলকে তিনি যখন নিজের পরিধিতে ঢুকতে দিলেন, আমরা আশ্চর্য হয়েছিলাম, ব্যথিত হয়েছিলাম, কিন্তু তা আর যাই হোক,  সুবিধাবাদ ছিল না। পদাতিক কবিকে সরিয়ে রেখেই আজকের বাঙালি কবিতা-লেখকদের দিকে তাকানো যাক।  দেখব, তাঁরা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের চেয়ে খুব একটা আলাদা নন, কোনও দূর গ্রহের প্রাণী নন যে তাঁরা নিজেদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে অবস্থান করবেন। আমরা যা ভাবতাম, বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ আমাদের অভ্যেস খারাপ করেছেন, কবির মাথার পেছনে কিন্তু আসলে কোনও আলোর বলয় নেই। বরং এটাই স্বাভাবিক যে বাঙালি কবিতা-লেখক আর পাঁচটা পেশাদারের মতো তাঁর জীবিকা ও শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করে চলছেন, যে স্থিতাবস্থার বদল তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের সামান্যতম হেরফের ঘটাতে পারে, তার বিরুদ্ধে উঠবে না তাঁর কলম, নতুন প্রভুর ঘটিয়ে চলা সামাজিক অন্যায়ও চোখে পড়বে না তাঁর। হ্যাঁ, এর পরেও কিন্তু তাঁরা কবিতা লিখবেন, রীতিমতো ভালো কবিতা, হয়তো বা গুটিকয় মহান কবিতাও, আমরা সেইসব কবিতা পড়বও, কিন্তু আমাদের ততক্ষণে মুখস্থ করে ফেলতে হবে যে কবি ও কবির কবিতা দু'টি আলাদা সত্ত্বা। কেউ কেউ এই প্রসঙ্গে বলবেন- দ্বিচারিতার দায় কবির, তাঁর কবিতার নয়। আমাদের ভাবনাকে এইভাবে বিযুক্ত করে না নিলে পাঠক হিসেবে আমাদের বেদনার চাপ বাড়বে। যেমন, আমাদের কৈশোরে, এক ধাক্কায় বাংলা গানের আকাশকে প্রসারিত করে দিয়েছিলেন যে নাগরিক কবি, আজ তাঁর গানগুলি শোনার সময় তাঁর বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থানের কথা মনে না করার কষ্টটুকু নিরন্তর করে যেতে হয় আমাদের। না হলে যে ঠগ বাছতে উজাড় হয়ে যাবে শিল্পের গাঁ!

পাশাপাশি এই উজাড় হয়ে যাওয়া গাঁয়ে এমন সামান্য কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের জন্য মানবিক চর্চার ওপর এখনও আস্থা রাখা যায়। দীর্ঘ ইতিহাসে বহু স্রষ্টা তাঁদের সৃষ্টিগুলিকে বারবার শাসক বিরোধিতার হাতিয়ার করেছেন, মানুষের সংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গোটা দেশ যখন রক্তবমি করছে, তখন কারও কবিতার শিল্পগুণ কিছুটা কম হলেই বা ক্ষতি কী? কখনও কখনও ট্রাকটরের পাশে কলম নামিয়ে রাখাটাও তো শিখতে হয়। পথ দেখিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।  সম্রাট পঞ্চম জর্জের  রাজত্বের রজত জয়ন্তী পূর্তির উৎসবে বিশেষ স্মরণিকা বার হচ্ছে এই বঙ্গদেশ থেকে, রাজস্তুতি করছেন জমিদার-সামন্ত-অমাত্য-বিজ্ঞানী-কবি-সাহিত্যিকসহ মুখ্য প্রজাগণ। সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে কিছু একটা লেখার অনুরোধ গেল কবির কাছেও, অসুস্থতার মিথ্যে অজুহাতে কবি সে অনুরোধ ফেরালেন। সালটা ১৯৩৫। স্বাধীনতার লড়াই তখন চরমে। এমন মুহূর্তে সম্রাটের উৎসবে সাম্রাজ্যের প্রধানতম উপনিবেশের একমাত্র নোবেলজয়ী প্রজা-কবির এক লাইনের প্রশংসাবাক্যও নেই, সেই যুগে দাঁড়িয়ে এই নীরব তাচ্ছিল্য গভীরতায় যে কতটা বাঙ্ময়, প্রায় যেন দ্রোহের সামিল। রবীন্দ্রনাথের সেই উচ্চতা এখনকার বাঙালি কবিতা-লেখকেরা পাবেন, ভাবাটা অপরাধ। বরং ফেলে আসা এক দশক জুড়ে আমরা দেখতে পেলাম কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাহিত্যিকদের দলে দলে আস্তাবল বদলের মরিয়া ঝোঁক। আমরা দেখলাম এই বেঁটেদের দেশে আমাদের কোনও জঁ পল সাঁত্র নেই, যিনি নোবেল ছুঁড়ে ফেলে শিল্পের মিনার থেকে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লিফলেট বিলি করবেন। আমাদের কোনও ব্রেশট নেই যাঁর নাটকের সংলাপে শাসকের আত্মা রাগে বিরক্তিতে কেঁপে উঠবে। তবু এই পোড়া সময়েও আমাদের একজন শঙখ ঘোষ আছেন, যাঁর শিরদাঁড়া অনেক নবীনের চেয়ে দৃঢতর, তাঁর একটি অতিসাধারণ কবিতাও তছনছ করে দিতে পারে ক্ষমতাতন্ত্রের ভণ্ড আড়াল। এই বাংলায় নবতিপর এক কবি কবিতা লিখে চলেছেন, আর লুম্পেন রাজনীতির দালালদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের স্বীকার হচ্ছেন, আর শাসকের অনুগ্রহভোগী অনুজ শিল্পীসাহিত্যিক মহল নিশ্চুপ বা ইনিয়েবিনিয়ে লঘু করে দিচ্ছেন ঘটনাটিকে- এই অভিজ্ঞতাটা সত্যিই আমাদের হওয়ার বাকী ছিল। শঙখ ঘোষ অবশ্য প্রতিক্রিয়াহীন, এই লঘুতার সামনে তাঁর কিছু প্রমাণ করার নেই। কিন্তু যাঁদের প্রমাণ করার দরকার ছিল, তাঁদের হিরন্ময় নীরবতাটুকু মহাকালের ঘরে জমা রইল।



ফিরে যাই শিমুলপুরে। জন্মোৎসবে সামান্য সময়ের জন্য কবিকে আনা হয়েছে ঘরের বারান্দায়। পরিষ্কার করে তাঁর দাড়ি কামানো হয়েছে আজ সকালে। পরনে নতুন লুঙ্গি ও সাদা ফতুয়া। বাইরে 'ফিরে এসো, চাকা' থেকে পাঠ করছেন তরুণ কবিরা। বাংলাদেশ থেকে পথিক নবী গান বেঁধে এনেছেন কবিকে শোনাবেন বলে- 'পাখি তুই বিনয়ের বাড়ি চলে যা'। তাকিয়ে দেখি- বিনয় মজুমদার উল্টোদিকের সুবিশাল আমগাছটার চেয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করছেন, সম্ভবত রোজকার চেনা পাখিটির ডাক। পরমুহূর্তেই- না, ভালো লাগছে না, হাত নেড়ে ভেতরে নিয়ে যাবার নিদের্শ। বাইরে উৎসব চলছে, উচ্ছাস ও প্রশস্তি, কিন্তু যাঁকে নিয়ে, তিনি পরম তাচ্ছিল্য রেখে নিভৃতে চলে গেলেন। এও আরেক নীরবতার দিকে যাত্রা, যে নীরবতা দিয়ে লেপেপুঁছে গুছিয়ে রাখতে হয় ব্যক্তিগত কবিতার ঘর। কারণ আতসবাজির সাড়া পেলেও প্রকৃত সারস উড়ে যায়।

3 comments:

  1. চমৎকার গদ্য । সাবলীল , স্বতঃস্ফূর্ত । সংহত । যুক্তি পরম্পরা চমৎকার । বিচ্যুতিহীন । লেখাটা সুন্দর ।

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ দাদা। উৎসাহ পেলাম। শুভেচ্ছা নেবেন।

    ReplyDelete