Tuesday, June 5, 2018

ফিরে পড়া কবিতা- লোকনাথ ভট্টাচার্য



পুনরুক্তির মাঝরাতে
হোক না পুনরুক্তি, তবু নিরুত্তাপ নয় যে-হাতটা বাড়াই তোমার হাতে–যা বলি, ভালোবেসেই। তাই খেদ নেই একই অরণ্যে-পথে, নিশীথিনীর শব্দহীন গন্ধহীন তমিস্রাতে আমি মশগুল স্নেহাকুল বুকে-বাজা ভোর নিয়ে, পাশে তোমাকে নিয়ে।
যেমন তোমারও, পা দুটোই আমার, পথটা তো নয়–তাই হোঁচট যদি খাও, রক্ত ঝরে, তো দোষ দিও পথেরই কর্তাকে। তুমি তো জানোই জানি, অরণ্যটাও আমার সৃষ্টি নয়, রাতটাও নয়। বুকে বাজে ভোর, দেবি, বুকে বাজে ভোর–শোনো, আমাদের পায়ে-পায়ে যে পৌঁছাতে চাওয়ার গান।
ক্লান্তি তোমার স্বাভাবিক, আমারও, এ-হাওয়াহীনতা গলা টিপে ধরে। যোঝার অস্ত্র শুধু ভালোবাসা, সেই নিশ্বাস তোমার-আমার–আর কী বলব এই রাতে?
অতএব হাত দাও হাতে, ফেলে যাবই এ-নিসর্গটাকে, পৌঁছোবই যেখানে অন্ধকার ক্ষীণ হয়ে আসে, গ্রামের প্রথম মুরগীটি ডাকে। তার একটু পরেই তোমার কপালে যেমন, আকাশেও লাল টিপ–গোলাপি আলোয় ধৌত মুখে অবশেষে বসব আঙিনায়।
বুকে বাজে ভোর, দেবি, বুকে বাজে ভোর।

অক্ষর হ’ল নদী
আমার নয়, অক্ষরের। মুক্তি আমাতে। নদী। চলেছে। তা শুধু বাড়াল বোঝা দুর্ভেদ্য অন্তরালের, পাষাণ জগদ্দলের, অচল, যাও আমার। একবার বলি, এইবার দরজা-খোলা, খিড়কি প্রস্তুত খোলার জন্যে, আমার হাতে । অন্যবার বলা বৃথাই, বলা আত্মার কান্নায়, খোলো দরজা–বলি। কাকে?
এই সৃষ্টি, দুটি হাত, আমার। আর ফুল ফোটে নির্লজ্জ। আর প্রিয়া ভালোবাসে। আর, ভালোবাসি ভাইকেও, কাছের, দূরের । কোলের পৃথিবী, যেন নারকেলের খোলের পৃথিবী, আবার যে-পৃথিবী দূরের, দোলে, এই এক মুঠোর বুকে।
আজ যদি ফিরে যাই সন্ধ্যায়, যদি না-ই যাই, তবে?
অক্ষর মুক্তি পেল আমাতে, রূপ দিতে অক্ষরকে।
ফিরে আমি যাব শেষে আজো সন্ধ্যায়, কারণ আমায় ফিরতে হবে, আবার চলার আগে, আবার ফেরার আগে। (কাল সকালে সূর্যোদয়, ফুল ফোটা, প্রিয়ার রাত্রির পরে) কারণ আনাগোনা, নিয়তি, মানুষের । ফেরার নয় অক্ষরের ।
ভাই, হাঁপিয়ে পড়েছ? আমি পেতে দেব আসন। আমি এনে দেব মাদুর, মেদিনীপুরের। দেব? ভাই
অক্ষর নদী হ’ল আমাতে। সে এখন বাঁচে আপনার স্বত্বাধিকারে।
মুক্তি কেন দেবে স্বাদ বন্ধনের? কোন মুক্তি মানবে না কিছুই, মুক্তি ছাড়া? ভাই, তুমি কেন হও না অক্ষরের?
বারবার চেয়েছি বাজাতে, যে-সংগীত তোলার ছিল, আজো তোলার আছে, আমার ঘরের বীণায়, যে-একই সংগীত বাজে দিনের, রাতের, দিনেরাতের ওপারের আঁধার বীণার তারে। এদিকে অক্ষর হ’ল নদী–আমার ধ্যানের সন্তান, আমাকে উল্টে ফেলে দিয়ে, আমাকে অস্বীকার ক’রে, ঐ চ’লে গেল সে, ঐ চ’লে যায়, আর নয় আমার ধরার, ছোঁওয়ার নাগালে।
সে পেল, পায়, যেখানে সব, সে-জগতে অন্য সূর্যাস্ত দিনশেষে–আমার, আমার প্রিয়ার চোখে তার আলোক পড়বে না।
এখানে–রইল স্বাদ শিকলের। নয় শুধু নির্বিশেষে শিকল, নিরুপায়, তার, নদীর অভাবের–কিন্তু এক অন্যতর শিকলের, যে প’ড়ে রইল ঐ স্বৈরিণী স্বয়ংবরা নদীর অবহেলিত কামুক, আক্রোশে।
ভাই, তুমিও রইলে সঙ্গে। তুমিও বুঝেছ। আর বলা কেন?


কৌটোর গল্প
ভ্রমণের পথ যেহেতু একই, রোজই, এভাবে যাত্রার বর্ণনা দিই কেন বার বার – এই তো প্রশ্ন?
উত্তর হল, সংখ্যার প্রতি আমার প্রেম।
যেন গম্বুজটা তিনবার আওড়ালেই তিনটে গম্বুজ হল, বা তিন কনে-দেখা আলোয় তিনটে ময়ূর হল, তিনটে তুমি হলে।
যেটা বলি না, কোনোদিনই না, সেই মনের গহনে সযত্নে বহন –করা কৌটোর ভীষণ অন্ধকারটাও তিনগুন হল।
আমি যে আজো আশা করে আছি, হে সুডৌল স্তনের মহিমা, আমরা ব্রমণে চির-সঙ্গিনী, একদিন নিজেই তুমি উদ্ধার করবে আমায় বার-বার এই একই ইঁটের সাজানো পিরামিড হতে, অবশেষে ঐ কৌটোর গল্পটা শুনতে চেয়ে।

মধ্যরাতে কবির উক্তি
আমরা সেই তারা, গত সূর্যাস্তের উল্কি ছিল যাদের গায়ে ও যাদের কোন ভ্রমে পারদর্শী নট ভেবে রাজার প্রহরী ধরে আনে দরবারে –ঝাড়লন্ঠন জ্বলে ঊঠেছিল তখনই, কারণ সন্ধ্যা হয় হয়।
রাজা বসেছিলেন ফ্রেমে-আঁটা ছবির মতো, ঢুলু ঢুলু চোখ, গোঁফে আঙুল চালিয়ে বলে ওঠেন, কী পার দেখি, কিছু তামাশা হোক।
দলের এই অধমই সেই সর্দার, অসভ্য অশোভন উক্তির সাহসে যার জুড়ি নেই, বলে উঠি, খেতে দাও-একবার, দুবার, পর পর তিনবার, তৃতীয়বার এত চেঁচিয়ে, হুমকি দিয়ে, যে হয়তো নিজেও চমকে ঊঠি, নাই বললাম মণি-মুক্তার পাখি বসানো সে মসৃণ মর্মর দেয়ালের বিড়ম্বনা।
রক্তচক্ষু রাজাঃ- ‘তবে এই বুঝি তামাশা তোমার?’ দে ছুট, দে ছুট, সঙ্গীদের নিয়ে, প্রহরীরা জাগবার আগেই-ফটক পেরিয়ে মাঠ, মাঠ পেরিয়ে বন, বন পেরিয়ে এখন এই অন্ধকার অরণ্যের গহনে, হন্যে হয়ে মধ্যরাতের দূরশ্রুত হায়েনার হাসির হাহাকারে হঠাৎ-হঠাৎ -কে কার খাদ্য কে জানে।
প্রহরীরা পিছু নিয়েছেই। জানি এবার যদি ধরে, আর দরবারের জন্য নয়, তা হবে রাষ্ট্রের শত্রু বলে কারাগারেই পুরতে।
সূর্যাস্তের উল্কি ছিল গায়। ভোরহীন গ্রামহীন হে অরণ্য এই, হে মধ্যরাত, আমাদের এই এক কবিতার সময়।
ছায়া
মুখোমুখি মৃত্যুর, মুখোমুখি রক্তের, মুখোমুখি জীবনের। আমারি মৃত্যুর, আমারি রক্তের, আমারি জীবনের।
আর এই দিগন্ত, দিনান্ত, বনান্ত।
আর এই কে বলে গেল স্বপ্নের কথা, ফিসফিস করে, খোলা হাওয়ায়? বলে গেল হঠাৎ। যেন আরো আছে এসব ছাড়িয়ে, আরো হাহাকার আনন্দের ও বেদনার, ও ব্যর্থতার- মধুর,মধুর ব্যর্থতার। যেন একটি অপেক্ষার, নিরীক্ষার প্রান্তর, যে চেয়েছে হতে ধানখেত অনাগত অন্য এক সূর্যাস্তের সুষমায়।
শুনলে কি গঙ্গা ধমনীতে? শুনলাম কি?
বন রইল বাঁ হাতে, মাঠ রয়েছে সামনে- যে আরো আছে ছাড়িয়ে এসব, তারি মধুর, ব্যর্থ,অনিবার্য পান্ডুলিপির মত। মাথার উপরে আকাশ হতাশার, আশার, দুরাশার। চোখে আমার দূর সপ্তর্ষির ঘ্রাণ,ইতিমধ্যেই। প্রিয়া তার যর্থাথ অন্তঃপুরে,অর্থাৎ অন্তরে আমার। বিহ্বল, বিলীন, অথচ জাগ্রত।
আমি এক মানুষ নামহীন, ক্ষীণকায় – তবু এই অল্প আলোয় আমার ছায়াও পড়ে গেল পাশের ভাইয়ের উপর, সেও চলেছে।

অনুক্ষণ সেই রাধিকা
অনুক্ষণ সেই রাধিকার কথা মনে হয়, যে একবার, কেবল একটি লহমারই জন্য, কী
ভেবে, বা কিছুই না ভেবে, চলতে-চলতে থমকে দাঁড়িয়েছিল, রাত্রি যখন ডানা-মেলা
ঈগলের মতো আকাশে-আকাশে,
সেই অভিসারিকা, যার হঠাৎ-স্থির গোড়ালি বুকে ধরে চিরকুমার মাটীর পৃথিবী হতে
চেয়েছিল মধ্যযুগীয় গীর্জার গাত্রে-খোদিত নতজানু যাজক,
আর যেন-অনন্ত খরার পর বৃষ্টি ঝরেছিল আমার শিরায়-ধমনীতে, রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা
এই বুঝি বেজে উঠল-উঠল শঙ্খধ্বনি, বাতাস পেল-পেল প্রাণ,
অনেকে যারা দ্বার-খোলা মাদুর-বিছানো ঘরে এসেছিলেন সেদিন, এমনিতেই,
বসেছিলেন কোনো প্রত্যাশা না করেই,
তারাও নিমেষে সে-কী করজোড় ভাস্কর্য, যাদুর মন্ত্রে উদ্ভাসিত কপাল–
যদিও হল না কিছুই, শঙ্খ বাজল না, চকিতে গতি ফিরে পেয়েই সে-নারী হারিয়ে গেল
দেওদার-অরণ্যে, পরে হয়তো দিগন্তে নীল রেখার মতো ভাসমান আরো-দূর পাহাড়ের
উদ্দেশে-উদ্দেশে।
শুধু প্রস্তুতির মুহূর্তটি আমিই আজও সাজিয়ে রেখেছি রেকাবিতে, দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস, ওরাও নিত্য-নিয়মিত আসছেন, তাই খোঁজখবর দেওয়ায়-নেওয়ায়
আমার কুটীর কলগুঞ্জনময়,
আঁধারে বিদ্যুৎ খেলা করে যায়।

বিকলাঙ্গ
কনুই-এর গুঁতো খেতে-খেতে এসে থেকেছি একটি ধূলিকণায়, জানি না তাতে স্বর্ণ
আছে কিনা, অথবা তা গোবরের ভস্মীভূত অংশ, কিম্বা তিন দিন আগে মৃত
উইপোকারই পিঠের ছালের একটুখানি।
অন্যের শরীরের প্রশ্ন উঠল বলেই এটাও জানানো ভালো, আমারও চোখটা-নাকটা-
ভুরূটা কে কোথায় যেন ক্রমশই কেড়ে নেয়, চোয়ালের খানিকটা কোন গিরগিটি
খাবলে নিয়ে গেছে, হাঁটুর কাছে গর্ত, যা দিয়ে শিরশির হাওয়া ঢোকে হাড়ে।
আমরা চোখটা আছে কোথায়?–ঐ দেয়ালের ছবির ফ্রেমে। নাকট্য?–কুলুঙ্গির
কৌটোর ভিতরে। ভুরূটা ?–ঐ-যে খড়টা হঠাৎ-হঠাৎ নড়ে-চড়ে, ঘুরে বেড়ায় এ-কোণ
থেকে ও-কোণে, তাইতে।
যদিও ভেবেছিলাম এসবই আমি বিলিয়ে দেব, সানন্দেই, জড়কে নয়, প্রাণের
জোয়ারে–ওঁ স্বাহা বলে ডান পথিকের ঘামকে, তোমার উচ্চারিত নামকে।
তাছানা ত্রিভুবনের অপ্সরী, সেই তুমিও তো স্বয়ং বসে রয়েছ সামনে, উরু-দুটি ফাঁকে
করে, আমাকে নিয়ে শয্যায় উঠে যাওয়ার আশায়,
যখন বাহাত অক্ষত হয়েও আমি সর্বাঙ্গে বিকলাঙ্গ, ফুঁ দিলেই ধ্বসে পড়ে যায়-যায় ঘর।
তাই ভাবনা, অবশেষের এই-যে ধূলিকণা, তাতে স্বর্ণ আছে কিনা–এমন যাদু যা
ফিরিয়ে দিতে পারবে হারানো অঙ্গগুলি।

উপরন্তু যার পুরুষাঙ্গ
আমাকে এইবার সেই কথা দাও যা নয় রাংতার বাক্সে মোড়া, রঙিন ফিতে-বাঁধা,
বড়লোকের খোকার জন্মদিনের টেবিলে মিষ্টি হেসে আলতো করে রাখার জন্য আদব
কায়দায়।
আমাকে এইবার কথা দাও যা উলঙ্গ তো বটেই, উপরন্তু যার পুরুষাঙ্গে হয়তো
সবেমাত্র গনোরিয়া ধরেছে, বা হয়তো গিয়েছিল প্রেমিকার দরবারে, ফিরে এসেছে
উপহাসের চাবুক নিয়ে মুখে, যে আবেদন করেছিল খোলা-বন্ধ সব দরজায়, তবু চাকরি পায়নি।
যার আঙুলগুলো বেঁকে গেছে ক্রোধে-গ্লানিতে-অনুশোচনায়, যে ছটপট করছে জ্বলে
উঠতে চেয়ে, পারলে ঝাঁপিয়েই পড়ে সাততলা বাড়ী থেকে,
পথে-দেখা বসন্তের-আঁচল-মেলে-দেওয়া সুন্দর-সুন্দর পটের বিবিদের স্তনগুলো
যে চটকে ছিঁড়তে চায়।
আমাকে কথা দাও এইসব ভাবতে পারার, বলতে পারার, পরে অট্টহাস্য ফেটে
পড়ার, না-হয় কনে-দেখা আলোরই গম্বুজ নিয়ে সামনে,
না-হয় এখনই, যখন তুমিও এক আশ্চর্য স্তনেরই রমণী, ঈপ্সিতা প্রেমে ও প্রত্যয়ে,
পাশেই রয়েছে বসে আপাত-শান্তির স্ফটিকের প্রাচীরে নিজেকে ঘিরে।

আমার মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা
আজ যারা চল্লিশ বা কাছাকাছি কোঠায়, আমার সমকালের সেই কত খোকা-খুকুদের
বলতে শুনি চোখ কপালে তুলে, নৈরাশ্যে-অবজ্ঞায়, “বাবা গো, কালে কালে দেখব
কত, কী অমানুষ হচ্ছে এই ছেলেমেয়েগুলো, কী অরাজক যুগ!”
আমি তো বলব, আবার যদি জন্মাতে পারতাম তোমাদেরই কালে, তোমার সঙ্গে এই
সকালসূর্যকে চুমু খেতে।
দেখছি তো, তোমরা শিখছ কত এই অল্প বয়সেই, শক্ত-শক্ত বীজগণিত-পাটীগণিত,
জৈব ও পদার্থ বিজ্ঞান–প্রাণের রহস্য, ফুলের সংকেত, আমরা তত শিখিনি। সময়
হলে ভালোবাসার যে-অট্টালিকা তুলবে, আমাদের বাড়ি থেকেও তা হবে অনেক সুদৃঢ়
কারণ ভিত্তি আরো গভীর।
আমি তো বলব, আবার যদি জন্মাতে পারতাম তোমাদেরই কালে তোমার সঙ্গে এই
সকালসূর্যকে চুমু খেতে।
তোমাদের ভোর এসেছে এক অন্ধ রাত্রির পরে, যার কিছু সাংঘাতিক কুয়াশা জানি
এখনো লেগে রয়। তাই পথে নামার অটুট প্রতিজ্ঞা তোমাদের, শত্রুর সঙ্গে এস্পার-অস্পার
যোঝার কী মরণপণ! বিশ্বাস করো, যা দেখেছি জ্বলজ্বল তোমাদের চোখে,
আগামী পথের অগ্নিসম্ভব দায়িত্বের এত বড় জ্ঞানে আমরা জাগিনি কোনোদিন।
আমি তো বলব, আবার যদি জন্মাতে পারতাম তোমাদেরই কালে তোমার সঙ্গে এই
সকালসূর্যকে চুমু খেতে।


বাইরে-ভিতরে বন
বাইরে তাকালে বন, ভিতরে তাকালে বন। এখনো দুটো দুরকম।
একটা শাল-তমাল-দেওদার, রৌদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ, ছায়ায় সুনিবিড় কোণগুলিকে
পোকামাকড়-পিপীলিকার আনন্দ। অন্যটায় নাম-না-জানা অন্ধকারের বসা, মণি-মুক্তার
হঠাৎ-হঠাৎ দ্যুতি।
তবু চোখ খোলায় ও বোজায় যে-কসরৎ, তাতে ইতিমধ্যেই ধীরে-ধীরে একটি
রসায়নের প্রক্রিয়া শুরু, লাল গেলাসে নীল মদ ঢালা। শাল-তমাল-দেওদারে মণি-মুক্তা,
অন্ধকারের বর্ষায় রৌদ্রে।
বাইরে তাকালে তুমি, ভিতরে তাকালে তুমি। এখনো দুজন দুরকম।
একজন গৌরবর্ণা, নাকে নোলক, পরনে ধনেখালি। অন্যজন কৃষ্ণাঙ্গী, হাতের কাঁকন
ভিন্ন অলংকার নেই দেহে, পরনে বেনারসী।
তবু ধীরে-ধীরে গৌরবর্ণার হাতে কাঁকন, কৃষ্ণাঙ্গীর নাকে নোলক–এক মোহনার
জল।
অপেক্ষা করছি আরো কতক্ষণ লাগবে দুটিতে মিলে সম্পূর্ণ এক হওয়ার, দ্বন্দ্ব ঘোচার,
পরে বহুদূরের যে-যাত্রীর দাঁড়িয়ে রয়েছে খেলা শেষ হওয়ার, তাদের সঙ্গে এ-
ঘরের ঐক্যকে বিদায় জানিয়ে
আমরা দুজনে বেরিয়ে যাব পরম বৈরাগ্যে।

কলকাতায় আজো বসন্ত
মনে টাটকা কৈশোরের মতোই, সারা বিশ্বে নোংরার প্রথমা প্রধানা রাণী কলকাতায়
আজো বসন্ত আসে–কৃষ্ণচূড়ার একই সমারোহ।
জাপানী যদি হতাম, গোটা তিনদিন তিনরাত ধ্যান করতাম সামনের কৃষ্ণচূড়াটার, তার
ফুল-পল্লব-প্রমত্ত রঙের রহস্যের, পরে আরো ঘণ্টা দুই সময় নিয়ে বাহারের কত রকমারি
কাটাকুটির পর সংক্ষিপ্ত আন্তরিক যদিও প্রথামতো অতি অর্বাচীনই চারটি লাইন লিখতাম,
এই যেমন
‘বসন্তে কৃষ্ণচূড়ার রঙ কী সুন্দর’ ইত্যাদি ইত্যাদি;
ও শেষে দীর্ঘ তৃপ্তির নিশ্বাসে বুকে ঢেউ তুলে উঠে পড়তাম–ধীর পা স্নানের ঘরের
দিকে–জীবন নিশ্চিতভাবে ধন্য জেনে।
এবং কে জানে, হয়তো পাঁচশো বছর পরে এক পুরাতাত্ত্বিক সম্পাদকের কোনো
ইউনেস্কো-সুলভ সংকলনে সে-কবিতা স্থান পেত টীকাসমেত, নামটা থেকে যেত।
অতএব এখন বুঝছ তো, আক্ষেপটা কোথায়?
কারণ উল্টে কৃষ্ণচূড়া, নিসর্গের চাবুক-কষা পরিহাস, আমার শহরের এ কী দিন এনে
দিলে দরজায়–সব কথার স্তম্ভিত অর্থহীনতার, ধেই-ধেই মৃত্যুর মুকুট-পরা-শির অন্য
আরেক কবিতা।


প্রৌঢ়া প্রেয়সী
এ-ব্যাধি বহুকালের। তাই ছেলেবেলায় যখন কবিতা লিখতাম, মাঝে মাঝে বিশ্বাসের
কথা বলেছি। আজ আর বলি না, কারণ হয়তো বয়স হয়েছে, পৃথিবীর ক্রূর
পাঠশালায় শিক্ষিত হ’য়ে বুঝেছি, বিশ্বাস ব’লে জিনিস নেই। তাই অবিশ্বাসও নেই।
আর সবই আছে, আমাদের সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত, বৃষ্টি-ঘাম-রোদ্দুর, তোমার চোখের চাওয়া,
খাওয়া আর পায়খানায় যাওয়া–দিনের পথে ঘোড়দৌড়, রাত্তিরের ঘুম। পায়খানার
নিত্য নৈমিত্তিক কোঁৎ পেড়ে চালান দেওয়া বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যত তর্ক, গতকালের
খাবার–আর আজকের খাবারের জন্যে প্রস্তুত হওয়া।
ছেলেবেলাকার সেই বটগাছটা যদিও আজও সমৃদ্ধ, জানি আর বিশ্বাস নেই সে-
বুড়োটারও। আমরা পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ঝিমোই।
মনে কোরো না এ কোনো সাবেকী দুঃখবাদী বক্তব্য–ঐ দুঃখটাও যদি থাকত তো
হয়তো বেঁচে যেতাম। আসলে বক্তব্যই নেই। আর–মনে পড়ে ? সেই মানুষী
করুণার দুটি গোলাপ আমার দুই হাতে দেবে বলেছিলে একদিন, তখন আমরা কিশোর
কিশোরী, দাওনি কেন? না প্রৌঢ়া প্রেয়সী, তুমিও সমানই অসমর্থ?
তবু পৌঁছোতে হবে মন্দিরে, পৌঁছোতে যে হবেই রাণী, কেন এই অকথ্য অবোধ্য
অভিপ্সা আজো আমার হাঁটুর অন্ধকার থেকে থেকে আকুল করে!

প্রেমের ও প্রেমাতীতের
বলতে হবে কেন এলাম?
এক পলক চাওয়ায় হানব সূর্যের রশ্মি ঐ শেওলা-পড়া দরজার বুকে–আনব ডেকে
যে-মন্থরতা মদিরতা রাত্রির, উন্মত্ত কোলাহলে।
যা ছোঁবে, তার সব হবে না আর পাথর; কান পাতলে শুনতে পাবে তাতে যোজন
দূরের কল্লোল, ক্রমাগতই এগিয়ে আসা।
আর সেই যাদু ঘটাতে গেলে একলা আমার আসা হবে অর্থহীন–এই আসা পাড়ি-দেওয়া
রাত্রি-অরণ্য-মরু (কেন ? কেন ?)–যদি না ঐ পদ্মচোখ তুলে তুমিও তাকাও,
দ্যাখো অতিথিকে।
জেনো আমার ফিরে যাবার নেই পথ, আসিনি ফিরতে।
এসেছি রিক্ত হাতে। ফুল গেছে শুকিয়ে আগুনের হাওয়ায়, দীর্ঘ যাত্রায়। শুকায়নি লগ্ন।

সে আমায় দিয়েছে
সে আমায় দিয়েছে এক আশ্চর্য আগুন-আমায় দিয়েছে সেই আগুনে অনির্বাণ জ্বলার মত তেমনি বিরাট এক অন্ধকার। তাতে প্রতি মুহুর্তেই খুলে গেল পথ, জ্বলে গেল বুক। তবু তাও শেষ নয়।
আমি বলি তাই তারই কথা কখনো চুপ করে, কখনো গুমরে গুমরে,কখনো মরতে মরতে, জ্বলতে জ্বলতে। এই পাথেয় অশেষ, আমায় মুক্তি দিয়েছে, দাস করেছে অসহ্য নিয়তির, এ আমার মস্তিষ্ককে চিরবিমূঢ় করে দিয়েছে একেবারে জন্মের মূহূর্তেই, অবাধ্য আভায়, অকাট্য আঁধারে।
আমি কেবল ছুটব, হাঁপাব,মুঠো-মুঠো ভরব অন্ধকার, ছুঁড়ে দেব আগুনে। আর আগুন লেলিহান হয়ে শত শত প্রসারিত করে তাকে গ্রাস করবে অট্ট হেসে।
এই পোড়া মাটিতে যে-ফুল ফোটাই আমার বেদনায়, সে আগুনের ফুল- টেক্কা দেয় কোটি যোজন দূরের তারার সঙ্গে। আকাশ তাকে দেখবার জন্যে হয়েছে পাষাণ-শতদল-মুখ ঘুরিয়ে বিস্ফারিত সে চেয়ে আছে তলার দিকে, বোঁটা তুলে অদেখা শূন্যে।


যাকে বাঁধতে চাই, ভালোবাসতে চাই, যার রূপ গড়ে তুলি মনে-মনে, তাকে বৃথাই ডাকতে চাই একটু মূহূর্ত ধরে, এই অনন্তে জ্বলন্ত রাতের কারখানায়।

No comments:

Post a Comment