Sunday, June 3, 2018

ধারাবাহিক গদ্য- দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়





ভালোবাসাগুলো সেলিব্রিটি হয়ে...যায়নি

ঘর খুঁজছে আমার প্রজন্ম।আদ্যন্ত বাস্তুহারা একটা প্রজন্ম। সামাজিক অবদমনে ঘাঁটা। ৩০ বছরের মধ্যে সবকিছু দেখে নেওয়া। চেখে নেওয়া। অনেক ঘর, অনেক বিশ্বাসঘাতকতা পেরিয়ে ঘর খুঁজছে তাঁরা।বারবার বিশ্বাসঘাতকতার পর।সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে। খুঁজছে শেকড়। আশ্রয়।বন্ধুতা। 
তাই, একদিন খুব ঘেন্নায় ছেড়ে যাওয়া শহরে আবার ফিরছে তাঁরা। রিসাইকেল করছে নিজেকে ও শহরকে।বুঝতে শিখছে ঘর থাকে মনে। ঘর থাকে স্মৃতিতে। হয়তো, মোবাইল ফোনে রাখা গানগুলোই ঘর। বা, বন্ধুর সাথে বিকেলে হাটাটা ঘর। 
“আমার এ ঘর বুহু যতন করে  
ধুতে হবে, মুছতে হবে মোরে”
সম্প্রতি কলকাতাকে দেখার চোখ বদলে ফেলেছি। যে চাওয়াগুলো শহরের প্রতি ছিল, তারো বদল ঘটেছে। খুঁজে বেড়াই নিউ-এজ এস্থেটিক। নতুন প্রজন্মের আধুনিকেরা আর গোলপার্কে আড্ডা মারে না। এমনকি, লেকেও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকেরা খুব যায় না আর। তাঁরা কাছাকাছির মধ্যে এক্রোপলিস যেতে চায়।তবু কি অদ্ভূত ভাবে দেখি, মাঝেমাঝেই সেজে উঠছে আমার শহর। নব্য ইন্সটলেশনের সাজে।কারা যেন এসে রঙ করে যাচ্ছে বিদ্যুতবাক্সগুলি। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যাসাগর, মাদার টেরেসারা। যেমন ব্রিস্টলের দেওয়ালে ব্যংকসির গ্রাফিতি সারি সারি। ডোভার রোড আর কেয়াতলা লেনে কারা যেন একে দিয়ে যাচ্ছে, ফুল আর শিশুদের উড়ে বেড়ানো। তাও কি আধুনিক ধাঁচে। আশা জাগছে মনে। আমরাও পারি। 
আমার প্রজন্মের পিঠে গত ১০ বছরের বিশ্বাসঘাতকতা।আসলে সবাধীনতার পর থেকেই ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতা। ৭০ এ তবু রাস্তায় গুলি চলত। দেখা যেত লাশ। এখন চলে ঘরে ঘরে। ধুপাধুপ পরে লাশ। কানে হেডফোন থ্রি কোয়ার্টারে হেঁটে বেড়ায় তারা। আমারই বন্ধু সব। চাকরি আর বিয়ে যে সিকিওরিটির নামে সবচেয়ে বেশি ইন্সিকিওর বুঝে গেছে তারা। তবে কি করবে? ৩০ বছরে এসে দেখতে পায় ধু ধু প্রান্তর।যারা কবিতা লিখতে চেয়েছিল, হতাশ হয়ে এন আর আই বৌমা হয়।কেরিয়ার হিসেবে ওটা বেটার। ইমেজ দেয় তারপর, কলকাতায় কিস্যু হয় না। মরা শহর। আসলে, বিজেপি এই ইমেজটা চায়। ভাষাটা মেরে ফেলতে এই ভাবেই।শহরকে খুন করে।
এই ফাঁকে প্রতিভাবান গবেট একদল যুবক বাংলা কালচারের দায়িত্ব নিইয়েছে। আসলে, সবাই ট্র্যাপড। সবাই। গোটাটাই মাজাকি। আমরা আর চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলতে পারছি না। প্রেমিকার সাথে আমায় পলিটিক্যালি ক্লারেক্ট থাকতে হচ্ছে।
তবু এর মাঝেই কলকাতার রাস্তায় দেখা হয়ে যায় হ্যম্লিনের বাশিওলার সাথে। যিনি কবিতা চাষ করতে চেয়েছিলেন।কবিতাকে মাইন করে পুঁতে রাখতে চেয়েছিলেন। পাহাড়ের গায়ে ভেড়ার পাল যেমন এগিয়ে চলে, চূড়ার গুম্ফার দিকে, সার্কাসের আগুন গোল্লায় যেমন ঢুকে পড়ে হাসতে হাসতে জোকার, তেমন অভিযাত্রার আহ্বানই করে ছিলেন কবি শুভজিত গুপ্ত। চেয়েছিলেন, বড় বেশি রকম চেয়েছিলেন সমস্ত রোগ সেরে যাক কবিতার জন্য।রেখে যেতে চেয়েছিলেন, নাগরিক রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোর গভীর সাধনার চোরাস্ত্রোত। ঘুমন্ত লাটাইয়ের মত বই তার চিহ্নছাপ। অর্থ, কীর্তি, সংসার, জন্মুছাপ, সন্তান পেরিয়ে তাঁর কবিতা আমার পাশে পাশে হাঁটে। আমি একটা বিন্দুর ভেতর দেখতে পাই ব্রম্ভাণ্ড।নারীর শরীরে যত পাশবিকতা, সাধুর অন্তরে যত সাধনা সমস্ত এসে জমা হয় তাঁর ভেতর। দেখি, রাতের রাসবেহারী আনোয়ার শাহ-র রাস্তারা আমায় আনমনে বলছে, পথের হলুদ ফুলে পা দিতে না। কারণ, ওগুলো কবিতা, ঈশ্বরের বীজ। প্রজন্মান্তরে যেন ছড়িয়ে যায় এই সত্য। কবি শুভজিত গুপ্ত আসলে সুরের গভীরে থাকেন। সেখানেই তাঁর গুহা। বাকি সবই তাঁর ছদ্মবেশ। 
 
কবিতার পথেই আরেকটু এগিয়ে দেখছি, কাফে কবিরায় বই প্রকাশ করছেন দেবরাজ চক্রবর্তী। একটা গোটা প্রজন্ম যখন বিদেশ যাওয়াকেই আদত জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করছে, তখন দেবরাজ বই প্রকাশ করছেন এ ভাষাতেই।আমার বরাবর মনে হয়েছে, আমাদের ভাষাকে-শহরকে স্বাধীনতার পর থেকেই হারিয়ে দেওয়ার একটা ধারাবাহিক প্রয়াস তৈরি হয়েছিল। তা আজ যথার্থ গন্তব্যে এসে পৌঁছেছে।কলকাতার প্রতি এলিটের যে উদাসীনতা, তা আজ যাথাযথ ভাবে কাজে লাগাচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদ।সন্ত্রাস আজ সর্বত্র, তবু কী অনবদ্য তাঁর প্যকেজিং।
এই ভায়োলেন্স আর এংস্টে দাঁড়িয়ে কবিতা লেখেন দেবরাজ। লেখেন সম্পর্কের কথা। এই প্রেম কাল্পনিক হতে পারে।একদিকে একটা মিথ্যা সমাজ আর অন্যদিকে কবির প্রেম। দেবরাজের কবিতা আর জীবন ভাবনায় বারবার মিশে যায় তাঁর চারপাশের সবকিছু।কবি তো সাধক।তাঁকে তো দাম দিতেই হবে।বারবার তাঁর হাত-পা কেটে নেওয়া হবে। ঘর ভেঙে দেওয়া হবে। তাঁকে আগুনে পোড়ানো অব্দি দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। দেবরাজ একা এমনই দাড়িয়েছিল। ছুরি খেতে খেতে সে তাঁর কবিতায় তুলে এনেছে সময়-চারপাশ। ভালোবাসা এই চার অক্ষরের শব্দকে পরীখ্যা করেছে সে। যতটা পরিস্রুত করা যায়, সে করেছে।  
যাত্রীরা নেমে গেলে
শেষ ট্রেন বিষন্ন মনে হয়
দু-এক স্টেশন পর
আমার আরোগ্যলাভ স্বাভাবিক
তুমি তা জেনেছ, বুঝেছ
দূরতব ভালোবেসে হেসেছ ধীর স্থির
হে রসহ্যময়ী, 
আমি যে সুষমা বুঝি
অধরামাধুরী ভেবে উষ্ণতা পানের পর বোঝা গেছে
এই মৃত্যু আর কিছু নয় বরং স্টেশন শেষে
পরবর্তী স্টেশনের অপেক্ষআয় থাকা। 
ঘর কি? উত্তর খুঁজতে থাকি আমিও। সিগনাল পেরনোর সময় কানে গুঁজে নিই হেডফোন। তারপর দেখি নাগরিক আকাশ কেমন ধীরে ধীরে ঘর হয়ে যায়।

No comments:

Post a Comment