Sunday, June 3, 2018

বিশুপাগলের মনোলগ : বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি










                                          বিশুপাগলের মনোলগ



অন্ধকার মধ্যরাত। আমাদের ক্যাম্পাস ঘুমে বিভোর। কোথাও কারও শব্দ নেই। নীরব। শুধু একটা পাগল চিৎকার করে উঠছে মাঝে মধ্যে। আর তাতেই সরব হয়ে উঠছে এই সামান্য গলি। আধভাঙা ঘুম পাশ ফিরে শুচ্ছে। আবার ঘুমিয়ে পড়ছে হয়ত। কিন্তু মুহূর্তের এই জেগে ওঠাটিকে যদি দৃশ্য ধরা যায়-- মাঝরাতের গাঢ় ঘুম থেকে এইযে সরবতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে একটা পাগল এবং তার চিৎকার-- ঘুমন্ত সমাজ অবচেতনে হলেও চাইছে এই চিৎকারটিকে। স্বাভাবিকভাবেই  চাইছে জাগানোর ভূমিকাটি নিক কেউ একজন। ঘুমন্ত সমাজটিও সামান্য গলির সামান্য একটা পাগলের কাছে নিজেকে সমর্পণ করছে। জাগতে চাইছে। অথচ, দিনের বেলা অন্য দৃশ্য।  শহর আপন কাজে ব্যস্ত। ছুটছে। পাগল তাকিয়ে মৃদু হাসছে। যেন তার কাজ নেই। কিংবা আপন মনে দেখছে ফুল ফোটা, সূর্যের রঙ, রঙিন কাগজের উড়ে যাওয়া। কিন্তু রাতে আবার চিৎকারের দৃশ্য। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না এই শান্ত, স্তব্ধ, নেতিয়ে পড়া ক্যাম্পাসের চিত্রটিকে। কিন্তু যদি বিরাট আঙ্গিকে দেখা যায়,   এতবড় ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তোলার প্রসঙ্গ এসে পড়ে-- আর তখন মনে হয় এই সামান্য চিৎকার বড় জোর পারে একটা ঘুমন্ত পাড়াকে এপাশ থেকে অন্য পাশে নেড়ে দিতে। হ্যাঁ, পারেই। আর পাগল এই সামান্য হলেও কাজটি পারছে, তার অন্তহীন স্বাধীনতা আছে বলে। তার ঘর নেই, সমাজ নেই, পাড়া নেই, প্রতিবেশী নেই, তোয়াজের পর্ব নেই নাকি আছে মনের ভেতরে ভয়ের দরজা। স্বাভাবিকভাবেই যখনই দেখছে সমস্ত পাড়া মৃতের মতো নিস্তব্ধ সেটাকে সে অস্বাভাবিক ভেবে চিৎকার করে উঠেছে। 

অন্যদিকে আমাদের আছে প্রভূত আয়োজন। সীমারেখা। লোহার কপাট। চাইলে ভাঙা যায়, চাইলে ভাঙা যায়না। কে চায় নিশ্চিন্ত আশ্রয় ভেঙে ঝড় জলে ভিজতে! কে চায় অনিশ্চয়তার পথে নিজের পা কে রক্তাক্ত করতে। আবার চাইলেও পিছুটান আঁকড়ে ধরে তাদের।   মধ্যরাত্রির  আকাশ ঝাঁকিয়ে তাই আমাদের চিৎকার গলা দিয়ে বেরোয় না। অন্ধকার আরও কালো হয়ে বসে। অথচ আমাদের মাথায় আছে 
" midnight shakes the memory 
As a mad man shakes a dead geranium" ( এলিয়ট) আর তখনই রবীন্দ্রনাথের পাগলকে মনে পড়ে। সেই পাগল দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। বাংলা সাহিত্য ভরে উঠছে শব্দে, ছন্দে, অলঙ্কারে। ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো সেই পাগল। আত্মস্থ পাগল। আবার কিন্তু অন্ধকার দেখলেই সেই পাগল জিরানিয়াম গাছকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠছে। মারের সাগর পার হয়ে ডেকে আনতে চাইছে অভয়ের আলো। প্রয়োজনে খেলনা পাতির মতো ছুড়ে দিচ্ছে শাসন দলের তোয়াজ-- নাইট উপাধি। আর তখনই ভয়ার্ত রাত গেয়ে উঠছে " বিঘ্নবিপদ দুঃখদহন তুচ্ছ করিল যারা/ মৃত্যুগহন পার হইল, টুটিল মোহকারা।" কিছুকাল পরে সেই পাগলের সঙ্গে বসবাস গড়লেন জীবনানন্দ। সামনে লক্ষ্য স্থির। সামনে সেই স্থির গাছ। ততদিনে পেঁচার নিঃশ্বাস তাকে শিখিয়েছে প্রশ্ন করে লাভ নেই। হাত পেতে দাঁড়ালেও কেউ দয়া ছুঁড়ে দেবে না। অন্ধকার শতাব্দীর মশাল নিজেকে জ্বালাতে হবে। নিজেকে এগিয়ে গিয়ে ঝাঁকাতে হবে গাছ। আর তাতেই ঝরে পড়বে মৃত পাতা। চেতনা। মৃত চেতনার উপরে ভারী গামবুট রাখলেই শব্দ জেগে উঠবে। সর্তক হবে শহর। ঘুমন্ত শহর। শুধু ওই গাছটিকে ঝাঁকানোর অপেক্ষা। কিন্তু ঝাঁকাবে কে? কবি? নাকি ওই অবহেলিত নিরপেক্ষ পাগল? ওই পাগল যে সর্বদা কবির অন্তরে বাস করছে? সমাজের সব দায়িত্ব বুঝি তার? ঘুমন্ত শহরে, সমাজে তারই বুঝি নাইট সিকিউরিটি চাকরি! না না চৌকিদার! কেননা তার ঘুম নেই, সোহাগ নেই, দল নেই, পাড়া প্রতিবেশী নেই--- আছে শুধু সীমাহীন ঔদাসীন্য। আর এই বিরাট নিঃসঙ্গতার অনুভব তাকে জাগরণ শেখাচ্ছে। শেখাচ্ছে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের বুকে আলো জ্বালাতে। যার কেউ নেই, কিছু নেই-- হারানোর মত বারান্দাটুকুও নেই--- সেই-ই কী তবে পারে সাহসী হতে? সেই কী আরও একাত্ম হতে পারে এই বিশাল পৃথিবীর সুখে-দুখে? আমরা তাই দেখেছি। তাই পেয়ে এসেছি এতদিন। কিন্তু আর কতদিন! কতদিন আর? 

   একটা একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে যাচ্ছে, অন্তরে। মর্গের টেবিল চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জীবন। ডাক্তারেরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অথচ চোখ তো ওই ঘুমন্ত জীবনটাকেই খুলতে হবে। চেষ্টা শক্তি ইচ্ছা শক্তি দুটোই ওই আধামৃত ব্যক্তিটির। হয়ত হবেও। ফিরবে জীবনে। আর ডাক্তার এখানে অনুঘটক। ডাক্তার ওই আশার আলোটি জ্বালাচ্ছেন এবং জ্বালাবেন। অথচ সরাসরি কোনও সম্পর্ক নেই রোগীর সঙ্গে, আহত ব্যক্তিটির সঙ্গে। বরং হত্যা, মৃত্যুর আশঙ্কা এবং জীবনের মাঝখানে নিরপেক্ষ আসনটিতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। দৃঢ়। আশাবাদী। আর তাতেই মশাল জ্বলে উঠছে। শুধু মশাল জ্বলে ওঠা পর্যন্ত তিনি। মশাল জ্বলে উঠলেই তার দায়িত্ব শেষ। বাকিটুকু নার্সদের কাজ, রোগীর আত্মীয়দের কাজ। ডাক্তার ফিরে যাবেন চেম্বারে। স্থির হয়ে বসবেন। অপেক্ষা করবেন পরবর্তী আলো অন্ধকারের খেলার। কাঁচি হাতে অপেক্ষা করবেন ওই অন্ধকারের, যাকে বাদ দিতে পারে তাঁর আঙুল কর্কশ হত্যাকারীর মতো। অথচ, তিনিও সমাজের। তাঁর প্রেম আছে, স্নেহ আছে, জীবনকে ভালোবাসা আছে-- ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে মোহনীয় স্বপ্ন আছে। আবার নির্মম এক কাঁচিও আছে। মৃত্যুর অন্ধকার তাই ভয়ে থ মেরে আছে। 

কবিও তাই। প্রকৃত কবি। নীবর। সাধনাময়। তাঁর সাধনা ক্ষেত্রে বাজছে আলো, রূপোর ঘুঙুর। সাদা সরস্বতী। দিস্তা দিস্তা কাগজ। নিজের সঙ্গে বসবাস। সমাজ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। একাত্ম হয়ে আছেন মনের ঘরে। অথচ, সমাজ চেয়ে আছে তাঁর দিকে। কেননা, তিনি কারোর নন। আবার তিনি সবার। তিনি নির্ভীক--তিনি নির্মম। বিবেকের সঙ্গে তাঁর বসবাস। কিন্তু ওইতো-- ঘরে তাঁর প্রেম এগিয়ে দিচ্ছে ভাতের থালা। স্নেহ এসে বলছে কাবুলিওয়ালার কথা। বাজারের ব্যাগে ভরে পড়ছে পুইশাকের গাঢ় সবুজ। কবি সুখী। কবি অসুখী। কবিও হাঁটছেন। কবিও বসছেন, ঘুমোচ্ছেন। কিন্তু সমাজ দেখছে কবির দেওয়াল ফাঁকা। অথচ, আসন্ন নির্বাচন। গণতন্ত্র। কবির সংসার দেখছে তাঁরা সমাজের কিন্তু সমাজের নয়। মিছিল বেরিয়েছে, চিৎকার করছে রাজপথ, স্লোগানে ভরে আছে কবিতার লাইন। কবি নীরব। শিশু দেখছে, বৃদ্ধ মাতাপিতা দেখছেন। নিস্তব্ধ। নীরব।  অথচ, কবির অন্তরে বাজছে রণদামামা। কবিও তাকিয়ে আছেন কালের দিকে। আর শিউরে উঠছেন। দেখতে পারছেন "We are city people without a language/ and some of us have even less". আর তখনই অস্থির কবি  রাত জাগছেন। কবি পায়চারি করছেন অন্ধকার বারান্দায়। কবি ভুল করে নিয়ে আসছেন গ্রীষ্মে ঝলসে যাওয়া লাল শাকের ডাঁটা। ছিঁড়ে ফেলছেন এতদিনের সরস্বতী বন্দনা। আর বুক পকেট থেকে বের করে আনছেন কলম--- লাল রক্তাক্ত ঝরণা কলম। খানখান হচ্ছে নীরব থাকা-- পালিত নীরবতা। আর কবির এই সাধারণ অসহায় অবস্থাকে তুলে ধরছে শব্দ-- 
" and the bitumen vine of wandering impetus/ drove night through the boaring/ and knocked our phone off the phone off the hook/ forever." ( Samuel Wagon Watson)

5 comments:

  1. নীপবীথি ভৌমিকJune 7, 2018 at 3:37 AM

    খুব ভালো লাগলো। আবারও পড়লাম।

    ReplyDelete
  2. ধন্যবাদ আপনাকে। ভালোলাগা জানবেন

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ আপনাকে। ভালোবাসা জানবেন।

    ReplyDelete
  4. দারুণ লেখা। উপন্যাসের পরিঘটনার মতো বয়ান। যুক্তির অনল কাব্যের হাওয়ায় ছন্দিত। সুন্দর।

    ReplyDelete