Sunday, June 3, 2018

নীরবতার ভাষা – কবিতার ভাষা, সাহিত্যের ভুবন: জয়ন্ত ভট্টাচার্য

ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি







                              নীরবতার ভাষা – কবিতার ভাষা, 
                     সাহিত্যের ভুবন




ভোরবেলাকার সমুদ্রসৈকতে দেখা গেল আপনমনে এক বৃদ্ধ জলের মধ্যে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছেন কিছু। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হল ঃ ‘এসব কী করছেন আপনি?’
‘জল যখন নেমে যাবে, ছোটো ছোটো এই মাছগুলি পড়ে থাকবে বালির ওপর, ফেলে দিচ্ছি তাই।‘
‘কেন? কেন করছেন একাজ?’
কেননা রোদের তাপ আরেকটু বেড়ে উঠলে এই বালির ওপরেই মরে যাবে মাছগুলো।’
‘কী আশ্চর্য! গোটা সমুদ্রতট জুড়ে হাজার হাজার পড়ে আছে এমন! কটাকে বাঁচাবেন আপনি? আপনি কি ভাবছেন আপনার এ কাজে এদের ভাগ্যের কোন ইতরবিশেষ হবে?’
ঠিক তখনই যে-মাছটাকে বৃদ্ধ ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন জলে, সেটিকে হাতে রেখে একটু ভাবলেন তিনি। আর তারপর বললেন; ‘অন্তত এই একটির জন্য তো হবে ইতরবিশেষ!’ বলে তাকে ফিরিয়ে দিলেন জলে। (শঙ্খ ঘোষ, বটপাকুড়ের ফেনা, ২৬)
কোন নিবিষ্ট নীরবতাকে আঘাত দিলেন ‘সরব’ কবি? কিভাবে দেখা যেতে পারে এই একান্ত গহনে নিজের মতো করে এক বৃদ্ধের আপন আনন্দের কাজ আর কৌতুহলী কবির প্রশ্ন পরম্পরাকে? আমাদের সবাক, সোচ্চার, স্ব-নির্ধারিত সকর্মক যাপনের বিপরীতে কি এই নীরবতার অবস্থান? কেবল নীরব হয়ে থাকাই কি নীরবতা? তার মাঝে কি কোন শব্দ কোন কথা পড়ে নেই? নীরবতা কি সবসময়েই সবাক কিংবা শব্দের বিপ্রতীপে অবস্থান করে? কিংবা নীরবতার খনিগহ্বর থেকেও সৃষ্টি হয় শব্দের সবাক উপস্থিতি? অথবা শব্দের জগতের ওপারে পড়ে থাকে নীরবতার বিস্তীর্ণ প্রান্তর?
টি এস এলিয়ট তাঁর Four Quartets-এর Burnt Norton-এ লিখছেন –
Words, after speech, reach
Into the silence. Only by the form, the pattern,
Can words or music reach
The stillness, as a Chinese jar still
Moves perpetually in its stillness.
Not the stillness of the violin, while the note lasts,
Not that only, but the co-existence,
Or say that the end precedes the beginning,
And the end and the beginning were always there
Before the beginning and after the end.
না। বোধহয় এখানে সব উত্তর নেই। নীরবতা তথা মৌনতা নিয়ে ভারতীয় হিন্দু দর্শন আবার অন্য কথা জানিয়েছে আমাদের। খানিকটা ঘুরপথে যাওয়া যাক। যে নীরবতা নিয়ে কথা বলছি আমরা তার ইংরেজি silence আর সংস্কৃতে একে বলে মৌন। মনিয়ের-উইলিয়ামস-এর সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে মৌন শব্দের অর্থ দিয়েছে – silence, taciturnity এর থেকে “মুনি” শব্দে পৌঁছেছে। মনিয়ের-উইলিয়ামস-এর দেওয়া অর্থ থেকে আমরা জানতে পারি মুনি “especially one who has taken the vow of silence”। এরকম এক উৎস থেকে ভারতে জন্ম নিল জ্ঞানার্জনের বিভিন্ন ধারার মধ্যে দুটি ধারা – মুনি ঐতিহ্য এবং সত্য ঐতিহ্য (Muni and Truth Tradition) মুনি ঐতিহ্য নীরবতা নিয়ে আলোচনা করে। নীরবতা কি করে নির্বাণ বা চূড়ান্ত জ্ঞানলাভের পথের সহায়ক হতে পারে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন দার্শনিকেরা, বিশেষ করে বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন। কিন্তু সাহিত্যের ভাষায়, কবিতার শরীরে ও আত্মায় নীরবতার কোন আলোচনা রইলোনা। প্রকৃত অর্থে থাকা সম্ভবও নয়। কবিতা ও সাহিত্যের একটি নিজস্ব ধরন এবং স্বতন্ত্র সত্তা নিয়ে গড়ে ওঠা তখনও অনেকদূরে। ফলে ধর্মাশ্রয়ী এবং পুরাণ বা উপকথা নির্ভর যে সাহিত্যসম্ভার গড়ে উঠলো সেখানে প্রকৃতি ও মানুষ এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা। সেখানে নীরবতা মানে শব্দহীনতা বা নির্বাক অবস্থা কিংবা মৃত্যু। সেখানে “নির্বাণ” বা “পরম মুক্তি” লাভের জন্য মৌনতা না সত্যপন্থা কোনটি বেশি শ্রেয় এ নিয়ে বিতর্ক থাকে, সাহিত্যজিজ্ঞাসা হিসেবে। (Disclaimer: ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন ধারা এবং সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে আমার অপার অজ্ঞতা এবং মূঢ়তা প্রকটভাবে জনগ্রাহ্য।)
এমনকি শেকসপীয়ারের সময় অব্দি (যেমন হ্যামলেট-এ) নীরবতা এবং মৃত্যুকে সমার্থক ধরে নেওয়া হয়েছে। মৃত্যুতেই কেবল নীরবতার ঠিকানা লেখা থাকে।
HAMLET
O, I die, Horatio;
The potent poison quite o'er-crows my spirit:
I cannot live to hear the news from England;
But I do prophesy the election lights
On Fortinbras: he has my dying voice;
So tell him, with the occurrents, more and less,
Which have solicited. The rest is silence. (Scene 5, Act 2)

১৮শ শতাব্দীর শেষদিক থেকে যখন ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে বড়ো বড়ো শিল্পায়নের ফলে মানুষ একদিকে প্রকৃতি থেকে ক্রমাগত বিযুক্ত হতে শুরু করলো, শ্রমিক নামক এক ঐতিহাসিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটলো যার নিজের শ্রমে তৈরি যে সামগ্রী বা বাজারী পণ্য তৈরি হচ্ছে তার ওপরে নিজের মালিকানা নেই। মালিকানা রয়েছে বৃহৎশিল্পের মালিকের হাতে। শুধু উৎপাদক হওয়া সত্ত্বেও উৎপাদনের সমগ্র প্রক্রিয়াটির ওপরে শ্রমিকের কোনরকম নিয়ন্ত্রণ নেই, পুরোপুরিভাবে এ প্রক্রিয়া থেকে সে বিযুক্ত। উৎপাদনের সাথে এভাবে যে দুধাপে শ্রমিকের বিযুক্তিকরণ তৈরি হল নিজস্ব শ্রম, শ্রমপ্রক্রিয়া এবং শ্রমজাত পণ্যের মধ্যে একে মার্ক্স অভিহিত করলেন alienation বলে।  আরেকধরণের alienation জন্ম নিল – একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের। শ্রমপ্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের আনাচে-কানাচে, মননে-চিন্তায়-যাপনে-অভ্যাসে পরিবর্তন আসতে শুরু করলো। বিশেষত, সাহিত্য-শিল্পের মতো সৃজনশীল ক্ষেত্রে এ পরিবর্তন এবং তার লক্ষণগুলো বেশি উদ্ভাসিত হল, পল্লবিত হতে শুরু করলো। ইতিহাসে ব্যক্তির উদ্ভব হল সমস্ত ধর্মতত্ত্ব, সামাজিক অচলয়ায়তনিক প্রথা, সংস্কারের বাঁধন ছিঁড়ে বেড়িয়ে চলিষ্ণু জিজীবিষু সত্তা হিসেবে। আবার এ ব্যক্তি সমষ্টির ভিড়ে হারিয়েও যায়, অনেকসময়েই তার “আত্ম”-কে ঘিরে যে বোধ তা ভেঙ্গেচুড়ে যায়। নতুন শিক্ষায় আর দৃষ্টিতে যারা পৃথিবীকে দেখতে শিখলো তারা জানলো – Cogito ergo sum – I think, so I exist – আমি চিন্তা করি, তাই আমার অস্তিত্ব। Cogito-র বিশেষ অবস্থান নির্ধারিত হল চিন্তনের, মননের চলনপথে। এলো reason এবং rationality। শব্দ, বাক্য, চিহ্ন, চিহ্নকের শৃংখল বেঁধে ফেলতে চাইলো আমাদের প্রকাশ। অনিবার্যভাবেই reason এবং rationality-র বাইরে গিয়ে, শব্দ, logos, eidos, বাক্য, চিহ্ন, চিহ্নকের শৃংখলের নিয়মকে অস্বীকার করে সৃষ্টির পদচারণা ঘটবে, সৃষ্টির নতুন পরিসর তৈরি করে নেবেন স্রষ্টা। এই পরিসরটি অনেকসময়েই নীরবতার পরিসর। সবাক সরব উচ্চারণ বা উপস্থিতির মাঝে কিংবা বাইরে অন্তর্লীনভাবে সন্নিবেশিত হল নীরবতার নিজস্ব স্তর, স্থান এবং পরিসর।
এরকম এক অবস্থা বোঝাতে গিয়েই দেরিদা জানান – “ Silence plays the irreducible role of that that bears and haunts language, outside and against which alone language can emerge.” (Derrida Writing and Difference : 54) আরো এগিয়ে বলেন - “the necessarily restricted passageway of speech against which all possible meanings push each other, preventing each other’s emergence.  Speaking frightens me because, by never saying enough, I also say too much” (Ibid, 83)
পুরীর সেই বৃদ্ধের কাহিনীতে একবার উঁকি মেরে নিই। উনি কি Michael Polanyi-“tacit knowing”-এর কথা অস্পষ্টভাবে মনে করিয়েছেন? – “we can know more than we tell.” Polanyi আমাদের ভাবতে বলেন – “how the structure of tacit knowing determines the structure of comprehensive entities” (Michael Polanyi, The Tacit Dimension)
একটু মনোযোগ দিয়ে ভাবলে বুঝতে অসুবিধে হয়না যে একটি টেক্সটে কোন চরিত্র বা চিত্রকল্প অনুপস্থিত বলেই হারিয়ে যায়না, তখনো থাকে সেখানে – অন্তরালে। তাহলে কি শব্দ, বাক্য এবং পাঠ নীরবতার বিপরীত দ্বিত্ব (binary opposite) হিসেবে কাজ করে? আমাদের উত্তর – স্পষ্টতই, না। শব্দ, বাক্য এবং পাঠের মাঝে অদৃশ্যভাবে অবস্থান করে নীরবতা, আবার নীরবতা যাত্রা করে সোচ্চার প্রকাশের দিকে। নীরবতা সবাক, দৃশ্যমান, আধিপত্যকামী টেক্সটের বা কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে, দাঁড়ায়ও। আমরা দেখবো সে উদাহরণ।
ওয়ার্ডসওয়ার্থের দুটি লাইন নীরবতার কথা বলে কি অদ্ভুতভাবে –
To me the meanest flower that blows can give
Thoughts that do often lie too deep for tears.
এরপরে দেখে নিই “প্রমিথিউস আনবাউন্ড”-এ প্রমিথিউস কি বলছেন -
প্রমিথিউসের আকুতি “বন্ধুরা কেন উত্তর দিচ্ছনা” নৈঃশব্দ, নিরুত্তর নীরবতার দিকে যাত্রা করে। প্রমিথিউস আবার ফিরেও আসেন স্বভূমিতে। আমি সে অংশে যাবোনা। আমার দেশের এক অনন্য কবিতায় ফিরি। নবারুণ ভট্টাচার্য – “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”।
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না”
কবির ভূমি কোথায়? কোথায় দাঁড়াবেন কবি? এক পরম নৈঃশব্দ, এক সীমাহীন নীরবতার মুখে এসে আমরা নিরুত্তর থাকি। নবারুণ পরম নৈঃশব্দ, সীমাহীন নীরবতার কল্পান্ত পার হয়ে উচ্চারণ করেন -
“আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেবো
বুকের মধ্যে নেবো কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল ও ভাসান
সমস্ত শরীর ঘিরে জোনাকী না পাহাড়ে পাহাড়ে জুম
অগণিত হৃদয় শস্য, রূপকথা ফুল নারী নদী
প্রতিটি শহীদের নামে এক একটি তারকার নাম দেবো ইচ্ছেমতো
ডেকে নেবো টলমলে হাওয়া রৌদ্রের ছায়ায় মাছের চোখের মতো দিঘী
ভালোবাসা – যার থেকে আলোকবর্ষ দূরে জন্মাবধি অছ্যুৎ হয়ে আছি –
তাকেও ডেকে নেবো কাছে বিপ্লবের উৎসবের দিন”
এ কি পাঠকের প্রত্যাশার সাথে একধরণের সাবভার্সন? নীরবতায় ডুবে যাবার মুখে পাঠক পরের পংক্তিতেই পৌঁছে যান এক আশ্চর্য আলোকবর্তিকার দুয়ারে! কবিতা আবার নীরবতাকে অতিক্রম করে বাঙময় হয়ে ওঠে কবির যাদুদন্ডের ছোঁয়ায়।
যুদ্ধের হিংস্রতম মুখ যিনি দেখেছেন, “তীব্রতম যন্ত্রণায় ছিন্নভিন্ন মুখ” যিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সেই কবি অডেন বিপ্রতীপভাবে প্রকৃতির মাঝে পেয়েছেন নীরবতাকে –
Silence invades the breathing wood
Where a drowsy limb a treasure keep,
Now greenly falls the learned shade
        Across the sleeping brows
And stirs the secret to a smile. (The Golden Treasury, 500)
ক্ষমতার যে অমিত শক্তি, রাষ্ট্রের যে বিপুল শক্তি শক্তির প্রদর্শনীতে যে সামাজিক নীরবতা তৈরি করে তাকে সুধীর উচ্চারণে, অন্তরের শক্তিকে জারিত করে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখে যান –
ক্রমাগত রক্তক্ষরণের
পিচ্ছিল নেপথ্যে আজও রয়েছে মানুষ – একা – নরক দর্শন করে,
                তবু অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়;
রক্ত মাংস কর্দমের পাহাড় ডিঙিয়ে, নদী সাঁতরিয়ে
নরক উত্তীর্ণ হ’তে ক্লান্তিহীন যাত্রা তার;
মাথা উঁচু রাখাই নিয়ম। (রক্তে ভাসে স্বদেশ সময়)
এখানে constructed এবং brutal নীরবতার সাথে সংলাপে রত সবাক, দৃঢ়প্রত্যয়ী কবিতা। সেরকম আগ্নেয় সময়ের আরেক কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য শ্বাপদ সময়ের স্বপ্রকাশিত সদম্ভ, সদন্ত, নেকড়ের মতো হিংস্র আবহকে তুচ্ছ করে নির্মাণ করেন নীরবতার সমাহিত অথচ প্রত্যয়ঋদ্ধ বিপরীত উচ্চারণ –
“অধ্যাপক বলেছিলো, “দ্যাট’স র-ঙ্, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?’
মাস্টারের কাশি ওঠে, ‘কোথায় বিপ্লব, শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!’
উকিল সতর্ক হয়, ‘বিস্কুট নিইনি, শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে।‘
চটকলের ছকুমিঞা, ‘এবার প্যাঁদাবো শালা হারামি ও.সি-কে।‘
তারপর? নীরবতা, কেবল নীরন্ধ্র নীরবতা –
“উনুন জ্বলেনি আর, বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটের তেজী রক্তধারা,
গোধূলি গগনে ঢেকেছিলো তারা।“ (রক্তে ভাসে স্বদেশ সময়)
মণিভূষণেরই আরেকটি অত্যাশ্চর্য কবিতা
‘অন্ধকার বিছানা থেক হামাগুঁড়ি দিয়ে বেরিয়ে এসে আলোর বালতি
উল্টে দেবে স্বাধীন শিশু। প্রথমেই ঘুম ভাঙবে মা’র, তারপর
গভীর নিরাপদে একে একে জেগে উঠবে পড়শীরা, বারান্দা থেকে
উঠোনে গড়িয়ে-পড়া সোনালি স্রোতের মধ্যে আদুল গায়ে
দুরন্তপনা করবে – সে-ও হয়তো এমনি এক রবিবার।”
আমার বিশ্বাস শব্দ, logos, eidos, বাক্য, চিহ্ন, চিহ্নকের সমস্ত অ্যকাডেমিক এবং টেক্সচুয়াল শৃংখলের নিয়মকে অস্বীকার করে, “দূর হঠো” বলে দূরে সরিয়ে রেখে জন্ম নেয় এরকম হীরকদ্যুতিসম্পন্ন কবিতার সম্ভার, বাংলার নিজস্ব সময়, আবেগ এবং সমাজ থেকে। একে অ্যকাডেমিক এবং টেক্সচুয়াল শৃংখলের ও rituals-এর মধ্যে ধরতে যাওয়া প্রকৃতপক্ষে কবিতাকে হত্যা করা। মহাভারতের চরিত্রের মতো কবিতাকে তার জন্মচিহ্ন, সৃষ্টিভূমি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা। এ নীরবতার ভাষা একান্ত আমাদের। একটি প্রতিজ্ঞাদৃপ্ত, অগ্নিক্ষরা সময়ের একান্ত আপনার প্রকাশ। একে পশ্চিমী ডিসকোর্সের techne দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা একধরণের textual tyranny। আবার নীরবতার আরেকরকমের আখ্যানও তো তৈরি হয় – আমি যাকে বলবো “আপেক্ষিক নীরবতা”। “পোস্ট-ট্রুথের দুনিয়ায় এই “আপেক্ষিক নীরবতা” শক্তি সঞ্চয় করছে। গুজরাতে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা বা মুসলিম হত্যার খরর কাগজের হেডলাইন হয়ে থাকবে বেশ কিছুদিন, যখন গৌরী লঙ্কেশ মৃত্যুর শীতঘুমে অপসৃত হবেন। অসংখ্য উদাহরণ। কটা চাই আমাদের?
এবার সুভাষ মুখোপাধ্যায় –
“যারা ভুলে গিয়েছিল –
তারা এখন
মোমবাতিগুলো ফুঁ দিয়ে নেভাচ্ছে
তার মানে
এ-গলি একটু আগে
অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল।
তার মানে একটু আগে এলে
এক নিস্প্রদীপ নৈঃশব্দে
আমি দেখতে পেতাম
মাথার ওপর
অনন্তনীলচক্র
কান পাতলে শুনতে পেতাম
উৎসে ফিরে যাবার
ছলাৎছল শব্দ।” (সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ১১৪)
আরেকবার কবি বলেন –
“আমি চাই কথাগুলোকে
পায়ের ওপর দাঁড় করাতে।
আমি চাই যেন চোখ ফোটে
প্রত্যেকটি ছায়ার।
স্থির ছবিকে আমি চাই হাঁটাতে।”
জীবনানন্দ-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ কবি শঙখ ঘোষ কী বলেন আমাদের? তাঁর “যখন প্রহর শান্ত” কবিতা –
“যখন প্রহর শান্ত, মধ্যম, নিবিড় আভাসিনী
সমস্ত ব্যসন কাম উজ্জ্বলতা ঘুমিয়ে পড়েছে
বাহির-দুয়ারে চাবি, আমি নতজানু একা
আমার নিজের কাছে ক্ষমা চাই, পরিত্রাণ, প্রতিটি শব্দের শান্তি –
বধির দিনের যাত্রী;
        কর্মে ছিল অধিকার, আমাকে কি সমর্পণ সাজে?”
নীরবতা থেকে বাহির হয়ে, আমাদের নতজানু হয়ে অস্তিত্ব যাপনের বিপ্রতীপে কবি আমাদের যেন বৈতালিকী শোনান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর “কবির মৃত্যু ঃ লোরকা স্মরণে” কবিতায় পাঠকদের নিয়ে আসেন এক বধ্যভুমিতে।
“সঙ্গে সঙ্গে রিপুর মতন ছ’জন
                বোবা কালা সিপাহী
                ঊঁচিয়ে ধরলো রাইফেল –“
কবির মৃত্যু হল –
“ষষ্ঠ গুলিতে কবির বুকের ওপর রাখা ডান হাত
                ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে গেল
কবি হুমড়ি খেয়ে পড়তে লাগলেন মাটিতে”
এরপরে পূর্ণ নৈঃশব্দ, যেমনটা কবি আমাদের জানান। কিন্তু এই নৈঃশব্দের মাঝে আরেকটি আখ্যান রচিত হতে থাকে – বাঙময় নয়, কবিতার মূল টেক্সটের অভ্যন্তরে।
“আসলে কবির শেষ মুহূর্তটি মোটামুটি আনন্দেই কাটলো
মাটিতে পড়ে থাকা ছিন্ন হাতের দিকে তাকিয়ে তিনি বলতে চাইলেন,
        বলেছিলুম, কিনা, আমার হাত শিকলে বাঁধা থাকবেনা!”
কবির মৃত্যু, কবির ছিন্নভিন্ন দেহ রাষ্ট্র, পুলিশ, হত্যা সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে হত্যাকারীর আধিপত্য ও উল্লাসকে ভেতর থেকে ভঙ্গুর করে দিল।
হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে জুলিয়াস ফুচিক বন্দী – মৃত্যুর প্রহর গুনছেন, একের পর এক প্রিয়তম কমরেডদের মৃত্যুর কালো দুনিয়ায় অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখছেন। নৈঃশব্দ, অন্তহীন নৈঃশব্দ। তার মাঝে প্রিয়তমাকে লিখছেন – “জীবন গান ছাড়া চলে না, আবার সূর্য ছাড়াও চলে না জীবন। এখানে গান আরও বেশী চাই, কেননা সূর্যতো আসতে পারে না। দুশো সাতষট্টি নম্বরের সেল উত্তর দিকে মুখিয়ে আছে, শুধু গ্রীষ্মকালে ডুবন্ত সূর্যের শেষ আভা আমাদের জানলার গরাদ ছুঁয়ে যায়, পূব দেয়ালে কয়েক মুহূর্তের জন্য চলকে পড়ে।” (ফাঁসীর মঞ্চ থেকে, অনুঃ অশোক গুহ)
বিচারের ভার তোলা রইলো পাঠকদের জন্য। এবার মহাশ্বেতা দেবীর “দ্রৌপদী”।
“দ্রৌপদী লাল চোখ ঘোঁচ করে তাবু দেখে। বলে, চল্, যেছি আমি।
সান্ত্রী জলের ঘটি এগিয়ে দেয়।
দ্রৌপদী উঠে দাঁড়ায়। জলের ঘটি মাটিতে ঢালে উপুড় করে। কাপড়টি দাঁতে ধরে টেনে ছেঁড়ে।
######
জেলে পাগলা ঘন্টি পড়লে যেমন হয়, ছুটোছুটি লেগে যায় এবং সেনানায়ক বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে এসে দেখেন সূর্যের প্রখর আলোয় উলঙ্গ দ্রৌপদী সোজা মাথায় হেঁটে তাঁর দিকে আসছে। সন্ত্রস্ত সান্ত্রীরা তার কিছু তফাতে।
এ কি? তিনি ধমকাতে যান।
দ্রৌপদী আরো কাছে আসে। কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়। উলঙ্গ। উরু ও যোনিকেশে চাপচাপ রক্ত। দুটি স্তন দুটি ক্ষত।
এ কি? তিনি ধমকাতে যান।
দ্রৌপদী আরো কাছে আসে। কোমড়ে হাত রেখে দাঁড়ায়, হাসে ও বলে, তুর সাঁধানের মানুষ, দোপদি মেঝেন।
######
দ্রৌপদীর কালো শরীর আরো কাছে আসে। দ্রৌপদী দুর্বোধ্য, সেনানায়কের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য এক অদম্য হাসিতে হাসে।
####
চারদিকে চেয়ে দ্রৌপদী রক্তমাখা থুথু ফেলতে সেনানায়কের সাদা বুশ শার্টটি ভেছে নেয় এবং সেখানে থুথু ফেলে বলে, হেথা কেও পুরুষ নাই যে লাজ করব। কাপড় মোরে পরাতে দিব না। আর কি করবি? লেঃ কাঁউটার কর্ লেঃ কাঁউটার কর্ -?
দ্রৌপদী দুই মর্দিত স্তনে সেনানায়ককে ঠেলতে থাকে এবং এই প্রথম সেনান্যক নীরস্ত্র টার্গেটের সামনে দাঁড়াতে ভয় পান, ভীষণ ভয়।”
রাষ্ট্র বনাম নীরবতা। আরেকবার শঙখ ঘোষ অমোঘ উচ্চারণ করেন –
“শূন্যতাই জানো শুধু? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে
সেকথা জানো না?”
পাঠকেরা শুনছেন?

1 comment:

  1. অসাধারণ লেগেছে নীরবতার ভাষা, সবই আমার চেতনার ভিতরে যেন এক দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। বিপরীত দ্বিত্ব আমাকে ঠেলে দিচ্ছে গহন নীরবতার স্পর্শ ভূমীতে। আমি তাকিয়ে আছি অথচ দেখছি তার থেকে অনেক দূরতম কিছু। আমার অস্থির ভিতরে সদা জাগ্রত পিলসুজ আমাকে আশ্রয় দিচ্ছে। সব মুখর পৃথিবী থেকে প্রকৃত শূন্যের দিকে।

    ReplyDelete