ক্রোড়পত্র: কবির নীরবতা ও নীরবতার কবি
নীরবতা ধ্বনি চায়, ধ্বনিও চেয়েছে নীরবতা
নীরবতা ধ্বনি চায়, ধ্বনিও চেয়েছে নীরবতা
কবিতা যখন পড়তে শুরু
করেছি, তার কিছুদিনের মধ্যেই টের পেলাম যে, কবিতা সবটা বলে না। না-বলা রেখে দেয়
অনেককিছু। আর কবিতার সেদিকটাই টানতে শুরু করল আমায়। সেই মুহূর্তে আমি জানতাম না
কবিতার মধ্যে কোথায় সেই নিঃশব্দ, কেন সেই নিঃশব্দের ব্যবহার, ভাষার মধ্যে দিয়ে
কীভাবে ধরতে হয় নিঃশব্দ -- কিন্তু তার অস্তিত্ব বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না তখন।
আস্তে আস্তে শুরু হলো এসব ভাবনা। হাতড়ে বেড়ানো। শুরু হলো তাই নিয়ে একটু আধটু পড়ার
আর খুঁজে দেখার চেষ্টা। চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম যে, এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত শঙ্খ
ঘোষের ভাবনাই আমার কাছে সবথেকে প্রাসঙ্গিক, যুক্তিগ্রাহ্য আর প্রামাণ্য লাগছে। ফলে
সেই ভাবনাবীজকেই আমি ছোঁয়ার চেষ্টা করবো এই লেখায়। শঙ্খ ঘোষের নানা গদ্য থেকে
উদ্ধৃতির কোলাজ দিয়েই স্পষ্ট করে তোলার চেষ্টা করবো সেই চিন্তার কারুকাজ। কিন্তু
তারও আগে আমাদের একবার ফিরে যেতে হবে ভাষার উৎস সংক্রান্ত একেবারে গোড়ার প্রশ্নে –
কেন তৈরি হলো ভাষা? ভাষার মূল উদ্দেশ্য কী? একের সঙ্গে অপরের সংযোগসাধন? সেজন্যই
কি নির্দিষ্ট শব্দে নির্দিষ্ট অর্থের আরোপ? কিন্তু সত্যিই কি সেই শব্দ বা
শব্দগুচ্ছ ওই নির্দিষ্ট অর্থের বোধ বা অনুভূতি পৌঁছে দিতে পারে আরেকজনের কাছে?
কারো সঙ্গে দেখা হলে এই
যে আমরা অভ্যাসবশত বলি ‘ভালো আছ তো?’ আমি কি সত্যিই জানতে চাই যে, সে কেমন আছে? সে
যদি তখন – ‘না, মোটেই ভালো নেই, কী করে ভালো থাকবো? আমার তো এই অসুবিধা, সেই
মুশকিল’, বিস্তারে এসব বলতে থাকে, তখন হয়তো খানিক মুশকিলেই পড়ে যাই আমরা, হয়তো
কখনো বিরক্তও হই। অথবা ধরা যাক, সামান্য যে-কোনো প্রাপ্তিতে এখন ‘ধন্যবাদ’ বলার যে
রীতি চালু হয়েছে, তাতে অনেকসময়েই আমরা সেই শব্দটা এমনভাবে ব্যবহার বা উচ্চারণ করি,
যেখানে শুধু শব্দটাই থাকে, তার ভিতরের ধন্যতার বোধটা আর থাকে না। কিন্তু এসব জেনেও
আমরা এগুলো বলে চলি, রীতি মেনে চলি। যদি আরও তলিয়ে দেখি, তাহলে 'একটু একটু করে যেন
টের পাওয়া যায় যে মানুষের মুখ অনেকসময়েই উলটোদিকে ঘুরোনো; যেভাবে সে আছে, সেভাবে
সে নেই। সে যা বলে, ঠিক তা-ই সে বলে না। মানুষের মধ্যে আরেকখানা আরেকখানা আরেকখানা
মানুষ, এই নিয়ে তার জীবন অথবা মৃত্যু। এই টুকরোগুলিকে সে হয়তো জুড়ে নেবার চেষ্টা
করে প্রাণপণ, কিন্তু তখনই তৈরি হয় আরো একটা নতুন অসংলগ্ন টুকরো। এই টুকরোর কোনো
শেষ নেই, তেমনি তাকে লগ্ন করবার চেষ্টারও শেষ নেই কোনো।'
একইভাবে -- হয়তো খানিক
অসচেতনভাবেই -- আমাদের গানে, কবিতায়, আমরা একই বাগ্ভঙ্গী বা বচনবিন্যাস বারবার
ব্যবহার করে যাই প্রায় যন্ত্রের মতো। ফলে অভ্যাসতাড়িত সেসব উচ্চারণ ক্রমেই হয়ে ওঠে
নিষ্প্রাণ, ক্লান্তিকর, গ্লানিময়। আমাদের মন, আমাদের অনুভব যেন ঠিকঠাকভাবে ধরা পড়ে
না সেখানে দিব্য এক ঘনতায়। কারণ ব্যবহৃত হতে হতে নষ্ট হয়ে যায় আমাদের সেই অভ্যস্ত
ভাষাবিন্যাসের পরিবহনক্ষমতা। তখন আমাদের অনুভব ওই অভ্যস্ত বিন্যাসের মধ্যে দিয়ে
তার তাপ, তার দাহ পরিবাহিত করতে পারে না আর। বহুদিনকার অভ্যাসে পৃথিবীতে আমরা
'সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি'। কিন্তু সে-রীতিতে আর তৃপ্ত হয়
না মন, কেননা 'মানুষের মন তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো / না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ;
এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল'। অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে, অনুভবের সত্যটাই
যায় হারিয়ে। তখন পড়ে থাকে শুধু সুলভ আর অর্থহীন এক মিথ্যের জঞ্জাল। অথচ 'সত্যি বলা
ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার। কিন্তু জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে
আছি দিনরাত', যে অনেকসময়েই এই মিথ্যেকে আর মিথ্যে বলে টেরও পাই না আমরা।
কিন্তু কাকেই বা বলবো
সত্য? এই যে আমরা খাচ্ছি, ঘুরছি, আড্ডা মারছি, রেগে যাচ্ছি, যা যা দেখছি শুনছি আর
তাতে তাৎক্ষণিক যা প্রতিক্রিয়া হচ্ছে – অর্থাৎ বাইরের যে জীবনটা যাপন করছি আমরা –
এইটাই তো সত্য। ঠিকই। কিন্তু বাইরের এই যাপন হলো বাইরের স্তরের সত্য, জীবনের পরিধি
ছুঁয়ে থাকা ঢেউ। আর আমাদের ভিতরে গভীরে, কেন্দ্রের দিকে, জমে ওঠে সেই যাপনের
নির্যাস। সেটাই ভিতরের স্তরের সত্য। তাহলে কবিতার সত্য কোনটা? কবিতায় যে সত্যের
কথা আমরা বলতে চাই, তার আছে এক পরিবর্তমান অবয়ব। আমাদের এই যে জীবন, এই যে যাপন,
'তাকে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সংঘর্ষে দেখাই কবিতার সত্য। সেই সত্যের সামনে কবির আমি আর
তাঁর বাইরের সমাজ কেবলই মুখোমুখি হয়, কেবলই তার সংঘর্ষ, আর সেই সংঘর্ষ থেকে কেবলই
আরেকটি তৃতীয় সত্তার উন্মেষ। তাই, চলমান এই জীবনের সামনে নিজের জীবনকে এনে রাখা,
গড়ে তোলা এবং ভাঙা, তৃতীয় এই সত্তার দিকে নিরন্তর আবর্তনের মধ্যে' দিয়েই কবিকে
এগিয়ে যেতে হয় সেই সত্যের দিকে। কিন্তু এগোতে গিয়ে তিনি টের পান যে, বাইরের স্তরের
অভ্যস্ত শব্দমালায় আর তার বিন্যাসে, প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে মিথ্যের কলরব।
ভাষার এই ফাঁকিটুকু,
শব্দের এই নিরর্থ ধরিয়ে দিয়েই কিন্তু একজন কবির কাজ শেষ হয় না। এটা ঠিকই যে 'কবির
শব্দ যেখানে থামে, আলোর সেখানে শুরু'। কিন্তু এই মিথ্যার অন্ধকার থেকে ওই সত্যের
আলোর তটভূমিতে, এক প্রতিশব্দহীন পরমতায়, পৌঁছে দেওয়ার জন্য ভাষা দিয়েই তো কবিকে
বাঁধতে হয় সংযোগের সেতু। আর ‘আমরা যখন সত্যিকারের সংযোগ চাই, আমরা যখন কথা বলি,
আমরা ঠিক এমনই কিছু শব্দ খুঁজে নিতে চাই, এমনই কিছু কথা, যা অন্ধের স্পর্শের মতো
একেবারে বুকের ভিতরে গিয়ে পৌঁছয়। পারি না হয়তো, কিন্তু খুঁজতে তবু হয়, সবসময়েই
খুঁজে যেতে হয় শব্দের সেই অভ্যন্তরীণ স্পর্শ।' অসাড় ভাষার মধ্যে সেই পরিবহনক্ষমতা
ফের জাগিয়ে তুলতে গেলে প্রয়োজন হয় ওই ছকবাঁধা বিন্যাসের অনায়াস পারম্পর্য ভেঙে,
অন্বয়গতভাবে নতুনতর এক বিন্যাসভঙ্গীতে পৌঁছনোর, মিথ্যের সেই গাঁটগুলিকে ভেঙে
ফেলার। আর 'একটি বাক্য বা বাক্যখণ্ডের মধ্যে শব্দ সাজাবার যে পদ্ধতি, তারই মধ্যে
থেকে যায় এই গাঁটগুলি। ঠিক শব্দের উপরেই আঘাত তত জরুরি নয়, যতটা জরুরি মধ্যবর্তী ঐ
অংশগুলির উপরে আঘাত, দুই শব্দের সংযোগ-বিন্দুর উপরে।' কিন্তু সেই সংযোগ-বিন্দু তো
অদৃশ্য! তাহলে? 'মেঘের আড়াল থেকে যে যুদ্ধ করে তাকে জিতে নিতে হলে মেঘের আড়ালেই
চ'লে যাওয়া চাই, অদৃশ্যের হাতে অদৃশ্যের মার।' এবার তাহলে ভাবতে হয় যে, কবিতায়
শব্দকে ধরে রাখে কে? কবিতায় শব্দকে ধরে রাখে যে ছন্দ বা স্পন্দন, তার মধ্যেই নিয়ে
আসতে হয় নতুন তরঙ্গ। বুঝে নিতে হয় আমাদের দৈনন্দিন বাচনভঙ্গীর ধাঁচ। আর তার
সাহায্যেই ভাঙার চেষ্টা করতে হয় তাকে। যেমন একই লোহায় তৈরি হলেও, শাবল দিয়ে আঘাত
করে করে ভেঙে ফেলা যায় লোহার শিকল, তার গাঁটগুলো। আর এভাবেই শব্দ এবং
শব্দ-বিন্যাসের বন্ধ্যাত্ব ঘুচে গিয়ে তাতে ফিরে আসে তার প্রবহমানতা। তখন 'প্রতি
দুই শব্দের মধ্যে কবির মুখই ভেসে ভেসে স'রে যায়'।
কাকেই বা বলা যাবে কবির
প্রকৃত মুখ? আসলে 'আমাদের অস্তিত্ব এমনিতেই ভিতর থেকে নানাখানা হয়ে আছে এবং তার
একটা দিক বাইরে মুখ-ফেরানো, অন্য দিক ধরা আছে কেন্দ্রে। এ-দুইয়ের মধ্যে সর্বায়ত
সংগতি যতই ছিন্ন হতে থাকে, কবিতা হয়ে ওঠে ততই বেদনারক্তিম, ততই টান-টান চেতনা ধরা
পড়তে থাকে এই দুই বিপরীত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।' বাইরে ফেরানো চোখে ধরা পড়ে এই
রণ-রক্ত-সফলতার পৃথিবী, তার দেশব্যাপী যন্ত্রণা তো কবিতার কথা হতেই পারে। ‘কিন্তু
সেই একই সঙ্গে কবিতা হতে পারে কবির নিজের জন্ম, তার জেগেওঠা, তার অবয়বহীন অভিমানময়
ভালোবাসার বিপুল উত্থান, চরাচরব্যাপী বিষণ্নতায় ধন্য।’ এ দুই ভিন্ন নয়, 'এ দুয়ের
মাঝে তবু কোনোখানে আছে কোনো মিল'। কিন্তু ‘কবি কখনোই ভুলে যান না যে এক হাতে এই
দেশনিহিত কাল আর অন্য হাতে দেশোত্তর কাল ধারণ করবার মুহূর্তেও তিনি পা রেখে
দাঁড়িয়ে আছেন অস্থির সমসময়ের সংকটের ওপর। সময়ের এই জটিল প্রত্যাঘাতই কবিতাকে এক
মুহূর্ত থেকে আরেক মুহূর্তে সঞ্চারিত করে নেয়।’
সময় বা কাল কবিতার
মজ্জায় কাজ করে কী করে? এই যে ‘আমরা বেঁচে আছি আমাদের একটা সমকালীন অভিজ্ঞতার
মধ্যে, এও এক সময়, কিন্তু এ হলো এক ব্যক্তিকাল। জীবনানন্দের শব্দ ব্যবহার করে বলা
যায়, আরো একটু 'অন্তর্যানী' হয়ে ওঠে যখন আমাদের মন, তখন এই ব্যক্তিকালকে দেখি অন্য
একটা সময়ের মধ্যে ভাসমান, তাকে বলা যাক মানবকাল, 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায়', সেই হলো এক ইতিহাস। কিন্তু আরো একটু 'অন্তর্যানী' হলে তবেই শুধু অনুভব
করা যায়, অনুভব করতে হয়, বিশ্বজাগতিক অনাদ্যন্ত কালপ্রবাহের মধ্যে আমাদের
বিম্ব-অবস্থান -- ভঙ্গুর ভারাতুর ভীতিময়, আবার সেই একই সঙ্গে রঞ্জিত রহস্যাতুর
রতিময় -- তার ধারক সেই প্রবাহ হলো এক বিশ্বকাল। আমি যদি আমার বাইরে এসে দাঁড়াতে
চাই, ব্যাপ্ত কোনো না-আমির মধ্যে, তাহলে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে দেখতে হয় এই
ব্যক্তিকাল মানবকাল আর বিশ্বকালের সম্পর্কের মধ্যে। কখনো হয়তো সে-সম্পর্ককে মনে হয়
সমন্বয়ের দিকে এগিয়ে-আসা অনেকখানি, কখনো-বা তাকে দেখি এক প্রবল সংঘর্ষে। ঢেউ কখনো
কখনো এগিয়ে এসে যেন পৌঁছে যায় তটে, পরের মুহূর্তে প্রবল অভিঘাতে সে আবার সরে যায়
দূরে, এই আঘাত-প্রত্যাঘাতের মধ্যেই জড়িয়ে যেতে থাকে আমাদের সমস্ত ব্যক্তিকাল
মানবকাল আর বিশ্বকাল, আমাদের সমাজ ইতিহাস আর প্রকৃতি। নিজেকে নিজের বাইরে এনে, এর
যে-কোনো-একটার সঙ্গেই নিবিড় সম্পর্কসূত্রে কেউ লিখতে পারেন কবিতা, আর কেউ-বা জড়িয়ে
নিতে পারেন এর সবকটিকেই একসঙ্গে, অবলীন এক অভ্যন্তরীণ সম্পর্কে।’ যেমন,
জীবনানন্দের ‘মহাপৃথিবী’ ও তার পরবর্তী পর্যায়ের কবিতায় আমরা এই সবকটিকেই একসঙ্গে
জড়িয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখি।
আবার যদি রবীন্দ্রনাথের
‘গীতাঞ্জলি’ বা শেষ চতুষ্কের লেখাগুলোর তাকাই, তাহলে দেখবো যে 'ব্যাপ্তির চেয়ে
গভীরতার চাপ এখানে বড়ো, পরিধির চেয়ে কেন্দ্রের। আর, কবিতা যখন সেই কেন্দ্রকেই
ছুঁতে চায়, তখন সে হয়ে আসে কথাবিরল সাজবিহীন, তখন তাকে মনে হতে পারে যেন সাহিত্যের
মধ্যে গণ্য হবার যোগ্য নয় আর, তখন তার যেটুকু ভার থাকে সে শুধু রসের ভার।' খুব
সহজেই তা থেমে যেতে জানে। ফলে সে লেখা পেয়ে যায় এক নিবিড় আয়তন। শব্দের অবধারিত যে
ন্যূনতম প্রয়োজন, তার বাইরের যাবতীয় অপ্রয়োজনকেই সে ছেঁটে ফেলতে পারে অনায়াসে।
কবিতাও তো আসলে এক ভাস্কর্য – শব্দের ভাস্কর্য। মনে পড়ে, নিজেরই এক ভাস্কর্য
সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মিকালেঞ্জেলো বলেছিলেন যে, ভাস্কর্যটা আগের থেকেই ওই
পাথরখণ্ডের মধ্যে ছিল; তিনি তেমন কিছুই করেননি, শুধু অতিরিক্ত পাথরটুকু কেটে সরিয়ে
দিয়েছেন। ভাষার ক্ষেত্রে সেই অতিরিক্ততা আমরা টের পাই কখন? ভাষা যখন নীরবতাকে ধারণ
করতে চায়, তখন। কিন্তু নীরবতাকে ভাষার ভিতর ধারণ করার প্রয়োজন হয় কেন একজন কবির?
কী করে তিনি টের পান সেই অতিরিক্ততার চাপ?
কবিতায় শঙ্খ ঘোষ লিখছেন
-- 'বাড়ি ফিরে মনে হয় বড়ো বেশি কথা বলা হলো? / চতুরতা, ক্লান্ত লাগে খুব?' বা
গদ্যে লিখছেন -- 'সমস্ত দিনের পর গভীর রাতে বাড়ি ফিরে গ্লানির মতো লাগে। কথা, কথা।
যেন একটু চুপ ছিল না কোথাও, থাকতে নেই, হাতে হাত রাখতে নেই। যে-নীরবকে খুঁজতে
বেরিয়েছিলে সবাই মিলে, কোথায় সে-সব মিলিয়ে গেল বাতাসে, যেন সে-সব জানতে নেই কখনো।'
তাই নিজেকেই নিজে বলতে হয় – 'এত বেশি কথা বলো কেন? চুপ করো / শব্দহীন হও'। কিন্তু
কাকেই বা বলবো শব্দহীন হওয়া? কারণ তার পরেই তো আছে – ‘লেখো আয়ু লেখো আয়ু’। তাহলে?
শব্দহীন বা নীরব হলে লেখা কিভাবে সম্ভব? ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ প্রবন্ধটির শুরুই
হচ্ছে এভাবে -- ‘বড়ো শক্ত ধাঁধা জানে ছোটো একটি মেয়ে। কথা বললেই কোন্ জিনিস ভেঙে
যায়?
আরো শক্ত জানতেন অবশ্য
দার্শনিক কীয়ের্কেগার্ড, তাঁর ডায়ারিতে যখন তিনি প্রশ্ন করেন, ঈশ্বর বিষয়ে মানুষের
কি কিছু বলার অধিকার আছে আরেক মানুষকে? কেননা তখন তো, তাঁর মনে হয়, টুকরো টুকরো
হয়ে যাবে পরমের সঙ্গে সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্কেরই তো অন্য নাম নীরবতা।’ অর্থাৎ,
তাহলে 'পরমকে স্পর্শ করবার যোগ্য পরম ভাষা হলো নীরবতা। বাক্য যেন সত্যের দিকে
এগিয়ে যাবার এক বাণিজ্যিক পদ্ধতি মাত্র, সে যেন শুধু বেচাকেনার বাজার। তখন এই
বাজার থেকে, শব্দের এই স্তূপ থেকে সরে যেতে চান কবি এমন এক দেশে, যেখানে ভাষা থেকে
বেরিয়ে আসে তার অন্তরতম সুর।' নীরবতার সুর। কিন্তু ‘এমনও কথা কি নেই যাতে নীরবও
গ’ড়ে ওঠে?’
দার্শনিক শচীন্দ্রনাথ
গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন – ‘সবটা বলার কথা নয় /
কথার শরীরে মাথা রেখে /
কেবল হারিয়ে যেতে হয়’। অর্থাৎ, এখানে ‘শব্দহীন’ বা ‘নীরব’ বা 'নিঃশব্দ মানে শব্দ
থেকে পালানো নয়, শব্দকে ঈথারমণ্ডিত ক'রে তোলা মাত্র, অভ্যস্ত শব্দসম্পর্কের আলস্য
ভেঙে দিয়ে তার মধ্যে সত্যের প্রবাহ নিয়ে আসা। কবিরই সেই কাজ।' ফলে 'নীরব দিয়ে
নীরবকে নয়, শব্দ দিয়েই নিঃশব্দকে ধরতে চান লেখক'। আর সেই কারণেই 'নতুন শব্দের
সৃষ্টি’ নয়, বরং ‘শব্দের নতুন সৃষ্টি’-ই কবির অভিপ্রায় হয়ে ওঠে। পুরোনো শব্দকেই
তখন টেনে নিতে হয় নবীনতায়। সেই নিঃশব্দ স্পর্শ করতে গেলে একজন কবিকে তাই 'লিখতে
হবে নিঃশব্দে কবিতা, এবং নিঃশব্দ কবিতা। শব্দই জানে কেমন ক'রে সে নিঃশব্দ পায়, ঐশ
সূত্র না ছিঁড়েও। তার জন্য বিষম ঝাঁপ দেবার দরকার আছে দুঃসহ আড়ালে থেকে।' কিন্তু
কোথায় পাবো তার খোঁজ? তবে কি আবার কবি ফিরে যাবেন প্রকৃতিতে? না। ‘কেননা প্রকৃতিও
বিষম বাচাল। মৌন জানে শুধু মানুষেরই বুক'। মানুষ যখন নিজেই নিজের মুখোমুখি বসে,
তাকায় নিজেরই দিকে, বুঝে নিতে চায় নিজেরই একান্ত ব্যক্তিগত স্পন্দন, তখন তাকে হতে
হয় সম্পূর্ণ নীরব। আমার নিজেরই মধ্যে, যে দেখে এবং যাকে দেখে -- এই 'দুয়ের মধ্যে
সম্পর্কেই আছে মৌনের বীজ।' ঠিক তেমনই, একটা শব্দের সঙ্গে আরেক শব্দের সম্পর্কের
মধ্যেও, বাসা বেঁধে থাকে নীরবতার বীজ।
'এই যে পিঁপড়ের মতো
ব্যস্ততা চলছে সমস্ত সংসার জুড়ে, নিয়মে হিসেবে বাঁধা, নির্বোধ ব্যক্তিগত উচ্চাশার
হানাহানি, মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে যদি কেউ সেই অবোধ চলার উলটো দিকে তাকান, তার সঙ্গে
তৈরি করেন একটা সম্পর্ক, অমনি দেখা দেয় অন্তরালবর্তী এক রোদসীরেখা, জেগে ওঠে আরেকটা
ঊর্মিময় দেশ। এই দেখাই, চলতি জীবনের আত্মার সঙ্গে এই গোপন সম্পর্কই কবিতা, এইখানেই
ধরা দিতে থাকে ভয়াবহ এক পরিণামহীন মীমাংসাহীন সত্য। আর এই সত্যকেই, এই সম্পর্ককেই
আবিষ্কার ক'রে নিতে চায় নীরবতা, শব্দমধ্যবর্তী নিঃশব্দ।' তখন, নীরবতার 'সেই বীজ
ফিরে পেতে চায় শুধু যাপনের নির্যাস। যাপন, যাপন। আছি, আমি আছি -- এই ধ্বনি যখন
শোনা যায় প্রশ্বাসের আবর্তে, কেবল তখনই দলবাঁধা সব শব্দ ধাবিত হয়ে চ'লে যেতে চায়
শেষহীন নীরবের দিকে।' উন্গারেত্তি যেমন লিখেছিলেন 'Between one flower picked and
the other given / The inexpressible nothing', সেভাবেই একজন কবিও যেন শব্দগুচ্ছকে
নীরবতা থেকে ছিন্ন করে আনেন 'নীরবতারই মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য,-- যেখানে কন্ঠ ফিরে
পায় তার সুঠাম স্বর, গতি ভিতরে জায়গা রেখে দেয় যতির জন্য।'
ভাষা, একজন কবির ভাষা,
কবিতার ভাষা, অনেকটা যেন সেলিম চিস্তির সমাধির শ্বেত পাথরের জাফরির কাজ। শব্দই যেন
সেই পাথরের নক্সা। অথচ তার ফাঁক দিয়ে আসা আলোও এক অসাধারণ শিল্প, হয়তো ওই নক্সার
চেয়েও বড় শিল্প। ওই ফাঁকগুলোই নিঃশব্দ। অথচ, ওই ফাঁকগুলো তৈরিই হয়ে উঠতে পারতো না,
পাথরের ওই নক্সা তৈরি না হলে। নিরেট পাথর ছেনে ছেনে এমনভাবে তৈরি করে তুলতে হয়েছে
ওই নক্সা, যাতে নক্সার সঙ্গে সঙ্গেই বোনা হয়ে যায় ওই ফাঁকগুলো। ওই পাথরের কাজ আর
তার অন্তর্বর্তী শূন্যতা – দু’য়ে মিলেই এই পূর্ণাঙ্গ শিল্পরূপ। ঠিক একইভাবে, শব্দ
আর নিঃশব্দ মিলেই, গড়ে তোলে কবিতার সম্পূর্ণ আকাশ।
[ঋণ – শব্দ ও নিঃশব্দ :
শেফালী মৈত্র, অনুষ্টুপ (শঙ্খ ঘোষ বিশেষ সংখ্যা)]
No comments:
Post a Comment